২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সস্তা জ্বালানি কি শেষ হয়ে যাচ্ছে?

-

বেসরকারি ভোক্তাপর্যায়ে কোনো পণ্যের চাহিদার সাথে সরবরাহ বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় সহনীয় থাকে। মূল্য প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু চাহিদার সাথে উৎপাদন না বাড়লে ওই পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। আর এ ঘাটতির কারণে দাম বেড়ে যায়। তবে এই ঘাটতির পরিমাণ যত বাড়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম তত বেড়ে যায়। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে হলে হয় বাড়তি দামে সমপরিমাণ পণ্য কিনতে হয়, নতুবা পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দেয়া হয়। আর জাতীয় পর্যায়ে হলে সরকার সংশ্লিষ্ট পণ্যের ভর্তুকি দিয়ে কম মূল্যে নাগরিকদের তা ভোগ করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এ ভর্তুকি দেয়া হয় জনগণের করের অর্থেই। সুতরাং প্রত্যক্ষভাবে পণ্যের দামের প্রভাব সাধারণের ঘাড়ে না পড়লেও পরোক্ষভাবে তা জনগণের ঘাড়ে পড়ে। এ কারণে জনগণের ব্যয়ের বোঝা কমাতে হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
কিন্তু দেশের জ্বালানি খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে গ্যাসের উৎপাাদন বাড়ছে না। আবার দেশের মজুদকৃত কয়লা উত্তোলনেরও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। দেশের কয়লা উত্তোলনের কার্যকর ব্যবস্থা না করে আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সাগর বক্ষের গ্যাস অনুসন্ধানের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নেয়া হয়নি স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা। আর এ কারণে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে যে বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে তা কিছুটা পূরণের জন্য উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে। আর এ কারণে জনগণের ঘাড়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ব্যবহারজনিত ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০০৯ সালে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। এখন সরকারি হিসাবেই এ ঘাটতি ১০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে গেছে। পেট্রোবাংলার গত ১৮ ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যান থেকে দখা যায়, শিল্প, আবাসিক ও পরিবহন বাদে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সারকারখানায়ই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে ১২১ কোটি ঘনফুট। যেমনÑ ওই দিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা ছিল প্রায় ২১০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হয় ১১২ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৯৮ কোটি ঘনফুট। আর সারকারখানাগুলোতে ওইদিন গ্যাসের চাহিদা ছিল প্রায় ৩২ কোটি ঘনফুট। কিন্তু ওই দিন সরবরাহ করা হয় প্রায় ১৮ কোটি ঘনফুট। ওইদিন সারকারখানাগুলোতে চাহিদার চেয়ে ১৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ করা হয়। নতুন উৎপাদন না বাড়ানো পর্যন্ত ২০০৯ সাল থেকে আবাসিক ও শিল্পে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এর পরও গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শিল্প ও আবাসিকে গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করে দিলে এ ঘাটতি আরো বেড়ে যেতো।
পেট্রোবাংলা থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে ছোট্ট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। তারপর আর কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। আবিষ্কারের উদ্যোগও তেমন ছিল না। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিকল্পনা পর্যায়েই আছে।
কিন্তু দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়লেও গ্যাসের মজুদ তেমন বাড়েনি, বরং মজুদ গ্যাস ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়তই তা কমে যাচ্ছে। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় মজুদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গত ১০ বছরে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি, যেমনটি নেয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আবার গ্যাসের ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন সময় কিছু কর্মসূচি নেয়া হলেও তা বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এরপর বাপেক্সকে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করানো হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাওয়ার আগেই সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাাম’ ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়। ওই কর্মসূচিও তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
বর্তমানে গ্যাসের সঙ্কট মেটাতে গত বছরের আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৪৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আগামী এপ্রিল থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার কথা রয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে দাম নিয়ে। প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে ৩২ টাকা করে। এ পর্যন্ত চার হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। প্রতি ঘনফুট বিক্রি করা হচ্ছে ৭ টাকা ১৭ পয়সা করে। এতে এ পর্যন্ত সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল থেকে এ ভর্তুকি আরো বেড়ে যাবে। এ ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্রাহকের ঘাড়ে মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গত ১১ মার্চ গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর ওপর আয়োজিত গণশুনানিতে পেট্রোবাংলা থেকে বলা হয়েছে, চাহিদার তুলনায় গ্যাস উৎপাদন কম। এ কারণে চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। এ ব্যবধান কমাতে হলে এলএনজি আমদানি করতে হবে। আর দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাইপলাইনে যুক্ত করতে হলে বছরে ভর্তুকি দিতে হবে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা।
উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেবে। কারণ, বর্তমানে আমরা দেশীয় গ্যাস পাচ্ছি গড়ে সাত টাকা দরে। আর এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে প্রতি ইউনিট ৩২ টাকা দরে। ফলে প্রতি ইউনিটের গড় উৎপাদন পড়ে যাচ্ছে ১২ টাকা। কিন্তু সামনে গ্যাসের মূল্য আরো বেড়ে যাচ্ছে। এপ্রিল থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হবে। গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পর্যায়ক্রমে ২০০ কোটি ঘনফুট, ৩০০ কোটি ঘনফুট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হবে। তখন গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এতে আমরা আর সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাবো না, উচ্চমূল্যের গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এলএনজি আমদানি যত বাড়বে, ভর্তুকি তত বড়বে, বাড়বে গ্যাসের দাম। তবে, সময় মতো গ্যাস উৎপাদন করার উদ্যোগ নিলে বর্তমান পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না জনগণের। বর্তমান এলএনজি আমদানি না করা বিকল্প ছিল অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো। এ সুযোগও ছিল আমাদের। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে দেশে নতুন করে উল্লেখ করার মতো কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। তিনি বলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হলেও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান চালানো হয়নি। যদিও সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার বেশ দ্রুততার সাথেই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। সমুদ্রবক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস আছে। যদি সেগুলো অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হতো, তাহলে এখন যে গ্যাস সঙ্কট রয়েছে তা হতো না। উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করতে হতো না। দেশে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে ১২ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। প্রতি বছর এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। সে হিসাবে ১২ বছরের মধ্যেই গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে দেশের জ্বালানি সম্পূর্ণ উচ্চমূল্যের জ্বালানিনির্ভর হয়ে পড়বে। গ্যাসের দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন মূল্য। শিল্পে অচলাবস্থা দেখা দেবে।
তবে, বর্তমানে এ থেকে উত্তরণের একটাই পথÑ আর তা হলো অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাপকভিত্তিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চালাতে হবে। বাংলাদেশের সাগরবক্ষে গ্যাস প্রাপ্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে এখন বাংলাদেশের ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অগভীর ও ১৩টি গভীর সমুদ্রে রয়েছে। বিদেশী কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহী হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে এ জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। মোট কথা, গ্যাস উত্তোলন নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নিলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বেড়ে যাবে। একই সাথে ৫০ টিসিএফ গ্যাসের সমপরিমাণ যে কয়লা দেশে মজুদ রয়েছে, তা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়। এর প্রভাব পড়বে জনগণের ঘাড়ে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
যশোর কারাগারে হাজতিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ব্যাপক আতঙ্ক চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত

সকল