২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মূল্য বৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে

-

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে সাধারণ গ্রাহকের ওপর। এ জন্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দেয়া মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর সিরিজ গণশুনানির আয়োজন করেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। ভোক্তা ও উদ্যোক্তারা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার পরও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। তিনি গত ১৪ মার্চ কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিতে বলেন, ‘গ্যাসের দাম প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে কোম্পানিগুলো।’ তবে কমিশন নিরপেক্ষ ও যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘২০০৯ সালে আমরা দেখেছি প্রস্তাব ছিল ৬৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। কমিশন প্রকৃতপক্ষে বাড়িয়েছিল ১১ শতাংশ। ২০১৭ সালে ৯৫ শতাংশ ছিল প্রস্তাবে কমিশন বাড়িয়েছিল ১১ শতাংশ। ২০১৮ সালে প্রস্তাব ছিল ৭৫ শতাংশ। কমিশন দাম বাড়ায়নি। এবার দেখছি প্রস্তাব হচ্ছে ১০২ শতাংশ। আমি শুধু এটুকু বলব, কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে যৌক্তিকভাবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বিবেচনা করবে।’ তার এ বক্তব্যে এবার গ্যাসের দাম বাড়ছে এটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
আইন অনুযায়ী, গণশুনানি শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে বিইআরসির ওপর। সে অনুযায়ী, ৯০ দিনের মধ্যেই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেবে বিইআরসি।
দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে সরাসরি বিরোধিতা করে উদ্যোক্তারা বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে, দেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
কে কী বললেন গণশুনানিতে : ১১ মার্চ ভোক্তা প্রতিনিধিদের পক্ষে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন। কারণ সেবা দেয়ার আগে কোম্পানি কোনো পণ্যের মূল্য দাবি করতে পারে না। কিন্তু পেট্রোবাংলা ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিয়ে ১০০ কোটি ঘনফুটের দাম চাচ্ছে। অথচ ভোক্তারা জানে না কবে নাগাদ তারা বাকি পণ্য পাবে। ১২ মার্চ তিতাস গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, হাইকোর্ট সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, কমিশন ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে পারে না, সেই কমিশন থাকলেই বা কি, না থাকলেই কি; একদিন জনগণ এমন প্রশ্ন করতে পারে। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক এবং বেআইনি। বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভ করার পরও দাম বাড়াতে চাইছে। তিনি বলেন, নতুন ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি এখনো আসেনি। বিইআরসিও জানে, আগামী এপ্রিলে এই এলএনজি আসবে না। তারপরও অদৃশ্য ইশারায় বিইআরসি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করছে। তিনি বলেন, সরকার বলছে পর্যায়ক্রমে চার হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আসবে। কিন্তু এতে কী পরিমাণ ব্যয় বাড়বে তা ভোক্তার জানা উচিত। কারণ যে ব্যবহার করবে সেই যদি না জানে, তাহলে কী করে সে দাম পরিশোধ করবে।
শুনানিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, শুধু দাম বাড়ানোর সময় আমাদের ডাকা হবে আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না, এটি ঠিক হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে গড় গ্যাসের মূল্য ছিল ৬ দশমিক ৯ ডলার বা এমএমবিটিইউ (ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট)। গত কয়েক বছরে মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির সাথে আমাদের ২৯ ভাগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হয়ে যাবেন এবং নতুন শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হবে না। এতে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে কোনো উদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগ করতে এলে তিনি জানেন না, তার জ্বালানি ব্যয় কত হবে। অথচ প্রতিযোগী দেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা আগাম ধারণা পান তাদের জ্বালানি ব্যয় কত হবে। আগে থেকেই জ্বালানি ব্যয়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করে তারা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু আমাদের এখানে হরহামেশাই বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। ফলে একজন উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করে ঝুঁকির মুখে পড়েন। তিনি ব্যবসার জন্য সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে একটি যৌক্তিক জ¦ালানি দরের পূর্বাভাস দেয়ার দাবি জানান।
তৈরী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্যাসে দাম বৃদ্ধির গণশুনানি হাস্যকর। তিনি বলেন, আমরা ২০১২ সাল থেকে আবেদন করে বসেছিলাম। সবে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এখন এসে বলা হচ্ছে দাম বৃদ্ধি করা হবে। তা হলে আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান কী করে করব। তিনি বলেন, তিতাস তার শেয়ারহোল্ডারদের ৩৫ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তো এক থেকে দুই ভাগও ব্যবসা করতে পারি না। তারা কী করে সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে এত বেশি মুনাফা দেয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, আমাদের কাছ থেকে বাতাস দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে তিতাস। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির পর আমরা বারবার বলেছি, আমাদের আঙ্গিনায় ইভিসি মিটার লাগিয়ে দেয়া হোক। যাতে আমরা প্রেসার অনুযায়ী গ্যাসের দাম দিতে পারি। কিন্তু আমাদের কথা শুনছে না তিতাস। আমরা আমাদের অপরাধ বুঝতে পারছি না। আমাদের যা গ্যাস দেয়া হচ্ছে, তার থেকে বেশি বিল নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানি। কিন্তু এর মধ্যেই আবার নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এবার অন্যায়ভাবে এই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাবি বিইআরসির কাছে দিয়ে যাবো। এ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, তৈরী পোশাকশিল্প ৪০ থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি করছে। তার পেছনে আমাদের টেক্সটাইল মিলের অবদান রয়েছে। পেছনে আমাদের ১৭ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছি। নইলে এই অর্থ বিদেশে চলে যেত। গ্যাসের দাম বাড়লে টেক্সটাইল মিল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কারা কত গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে চায় : ১১ মার্চ পেট্রোবাংলার লিখিত আবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের কোম্পানি বিজিএফসিএলের কাছ থেকে ৭৭২ এমএমসিএফডি গ্যাস ৭০ পয়সা হারে (ঘনমিটার), বাপেক্সের কাছ থেকে তিন টাকা ৪ পয়সা হারে ১০৮ এমএমসিএফডি, এসজিএফসিএলের কাছ থেকে ২০ পয়সা হারে ১২৪ এমএমসিএফডি, আইওসির কাছ থেকে ২ দশমিক ৫৫ টাকা হারে ১৭১২ এমএমসিএফডি গ্যাস কেনা হচ্ছে, যার ইউনিট প্রতি দাম পড়ছে গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় টাকার মতো। আর আমদানি করা এলএনজির দাম পড়বে ৩৯ দশমিক ৮২ টাকা। বর্তমানে গড়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৭ দশমিক ১৭ টাকা দরে বিক্রি করছে। এর সাথে এলএনজি চার্জ ৯ দশমিক ৫৫ টাকা হারে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মো: নজরুল ইসলাম। এতে বলা হয়, বর্তমানে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। আগামী এপ্রিল থেকে আরো ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। ফলে প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডে সরবরাহে বছরে ২৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ঘাটতি তৈরি হবে। এ জন্য গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় ৮ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ১২ টাকা ১৯ পয়সা নির্ধারণ করা জরুরি।
১২ মার্চ গণশুনানিতে সব শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য গ্যাসের দাম গড়ে ১০৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। গৃহস্থালি পর্যায়ে দুই বার্নার চুলার জন্য গ্যাসের দাম ৮০০ টাকা থেকে ১৪৪০ টাকা এবং এক বার্নার চুলার দাম ৭৫০ থেকে এক ১৩৫০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। শিল্প ও সারকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৩ মার্চের গণশুনানিতে বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩.১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯.৭৪ টাকা (২০৮ শতাংশ), সার কারখানায় ২.৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৪৪ টাকা (২১১ শতাংশ), সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮.১০ টাকা (৫০ শতাংশ), ক্যাপটিভ পাওয়ার সংযোগে ৯.৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮.০৪ টাকা (৯৬ শতাংশ), শিল্পে ৭.৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪.০৫ টাকা (১৩২ শতাংশ), বাণিজ্যিকে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪.০৫ টাকা (৪১ শতাংশ), গৃহস্থালিতে এক বার্নার চুলায় ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫০ টাকা, দুই বার্নার চুলায় ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৪০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়।
প্রসঙ্গত, বাখরাবাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৯টি, সারে একটি, শিল্পে ১৬৮টি, সিএনজি স্টেশনে ৯১টি, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৭৮টি, বাণিজ্যিকে দুই হাজার ১৩৯ এবং আবাসিকে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৯ জন গ্রাহক রয়েছে।
১৪ মার্চের গণশুনানিতে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সব ধরনের গ্যাসের দাম ১০৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে। এর মধ্যে সার উৎপাদনে ২১১ শতাংশ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। আর আবাসিক গ্যাসের ক্ষেত্রে এক চুলা ১৩৫০ ও দুই চুলা ১৪৪০ টাকা করা হয় সংস্থা দুটির পক্ষ থেকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement