২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুদ্রানীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

-

মানুষের হাতে বেশি টাকা এলে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে চায়। বেড়ে যায় মানুষের প্রত্যাশা। আর এ প্রত্যাশা থেকে ভোগবিলাসের দিকে ধাপিত হয়। পাল্টে যায় মানুষের জীবনমান। ভোগবিলসের পেছনে ব্যয় হয় অতিরিক্ত অর্থ। এতে কোনো একক পণ্য কিনতে বেড়ে যায় প্রতিযোগিতা। ১০ টাকার পণ্য বিক্রি হয় ২০ টাকা। আর ২০ টাকার পণ্য ৪০ টাকা। এভাবে কোনো একক পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ থেকে ক্ষেত্রবিশেষ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। টাকার ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। একেই বলে মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে সাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। দুর্ভোগ বেড়ে যায় নির্ধারিত আয়ের মানুষের। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাই নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়। নেয়া হয় আগাম পদক্ষেপ। নির্ধারণ করা হয় লক্ষ্যমাত্রা। অর্থনীতির আকার, ধারণক্ষমতা অনুযায়ী মুদ্রা সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা হয়।
মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বছরে দুইবার এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেটা আগাম মুদ্রানীতি নামে অভিহিত। বছরের প্রথমেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের মধ্যে একবার এবং জুলাই মাসের সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। প্রথম দফায় জানুয়ারি-জুন এবং দ্বিতীয় দফায় জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে মুদ্রানীতির লক্ষ্য ঠিক করা হয়। অর্থনীতির সার্বিক সূচকের গতিবিধি বিবেচনা করে মুদ্রা সরবরাহের শেষ সীমানা নির্ধারণ করে। এর বাইরে গেলে অর্থনীতির সার্বিক সূচক বিশৃঙ্খলা হয়ে পড়ে।
গত কয়েক বছরের মুদ্রানীতির বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের দিকে তাকালে দেখা দেয়, বাস্তবে মুদ্রানীতি অর্থনীতির জন্য কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলা যায়, অর্থনীতির জন্য খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না আমাদের মুদ্রানীতি। যদি এর কারণ খোঁজা যায়, তাহলে বলা যায় এর অন্যতম কারণ হলো মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়হীনতা।
সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করার কিছুই নেই। তেমনিভাবে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অবকাঠামো সুবিধার অভাব ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা হলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগমুখী করার উদ্যোগও তেমন সফলতা আসে না। অপর দিকে, উৎপাদন কম ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে পণ্য সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টি হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ কাজে আসে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির দিকে তাকালে এটাই প্রতীয়মান হয়।
বিগত ৬ মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে ডিসেম্বর শেষে অর্জন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আবার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। অর্জিত হয়নি বাজারে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল।
সরকার বাজেটে তার ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। একই সাথে বাজেট ঘাটতি মেটাতে নেয়া হয় ঋণের লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলে সরকার তার উন্নয়ন ব্যয় ঠিক রাখতে ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে করার কিছু থাকে না বাংলাদেশ ব্যাংকের। সরকার বেশি মাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণের ব্যয় বেড়ে যায়। কারণ, বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের তখন টান পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার বেড়ে যায়। আর ঋণের সুদহার বেড়ে গেলে বেড়ে যায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আবার কোনো কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উৎপাদন কমে গেলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এভাবেই কার্যকারিতা হারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি।
চলতি অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেকের কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে অর্জিত হয়েছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।
গত ৩০ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের লাগান টেনে ধরা হয়েছে। এতে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। একই সাথে নির্ধারণ করা হয়েছে বাজারে টাকার প্রবাহ আরো বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এ খাতে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। যদিও গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এ খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
গত ৬ মাসে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ৮ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে অর্জিত হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মতো চড়া সুদে ঋণের পরিবর্তে এখন ব্যাংক থেকে কম সুদে নেয়ার জন্যই সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে।
এ দিকে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের জোগান বাড়াতে মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ শতাংশ। সে লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। ব্যাংকিং খাতে আমানত সংগ্রহ ও অন্যান্য উৎস থেকে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানো হবে। এ দিকে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বা টাকার প্রবাহ আগের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১২ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে ডিসেম্বর পর্যন্ত টাকার প্রবাহ যা বেড়েছে, তার ওপর আরো ১২ শতাংশ বাড়ানো হবে।
নতুন মুদ্রানীতির কৌশল বাস্তবায়নও কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, গত ৬ মাসের ধারাবাহিকতায় বাজারে মার্কিন ডলারের মুদ্রার মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। কারণ, বৈদিশিক মুদ্রার চাহিদা যে হারে বাড়ছে সেই হারে সরবরাহ বাড়ছে না। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না রফতানি আয়। ওদিকে দাতাগোষ্ঠীগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার অবমুক্তি করছে না। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ করেছে। এসব ঋণ সুদে আসলে পরিশোধ শুরু হয়েছে। সেই সাথে বাড়ছে পণ্য আমদানি। ফলে সামগ্রিকভাবে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ আরো কমে যাবে। কমে যাবে টাকার মান। এতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। আবার অভ্যন্তরীণ বাজারেও ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যাবে। সবমিলিয়ে মূল্যস্ফীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে আর একই সাথে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কিভাবে বাড়ানো হবে সেটাই এখন মুখ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
যশোর কারাগারে হাজতিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ব্যাপক আতঙ্ক চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত

সকল