ক্ষমতায় আরোহণ করেই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যা যা করার সবই করেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান । ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করতে উচ্চাভিলাসী এই যুবরাজ অনেক নৃশংসতাকেও হার মানাতে পারেন। ইতোমধ্যে তিনি সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগীকে তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে তার অনুগত বাহিনী দিয়ে হত্যা করেন।
ইয়েমেনে সৌদি আরবের সমর্থনপুষ্ট সরকার বসাতে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে সফলতা না আসা কিংবা ক্রাউন প্রিন্স শিগগিরই দেশটির ক্ষমতা পুরোপুরি নিজের হাতে নিতে যাচ্ছেন, এমন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কি দেশটির সেনাবাহিনীতে রদবদল হলো। ধারাবাহিক সংস্কারের অংশ হিসেবে নারীদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এসব নাটকীয় পরিবর্তন আনা হচ্ছে ক্রাউন প্রিন্সকে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে।
তবে সেনাবাহিনীতে রদবদলের কোনো জুতসই ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি সৌদি শাসকেরা। আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি সেনাবাহিনীর আরো ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণের ইঙ্গিত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি ইতোমধ্যে সৌদি আরব পৌঁছেছেন বাদশাহ সালমানের আমন্ত্রণে।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড হায়কেল মনে করছেন, সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের সংস্কারের অংশ হিসেবেই রদবদল শুরু করেছেন সৌদি শাসকেরা। ইয়েমেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৌদি শাসকেরা বুঝতে পারছেন, তাদের সেনাবাহিনীতে দুর্বলতা রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছ থেকে সর্বাধুনিক অস্ত্র কিনতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে সৌদি আরব। অথচ এসব অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতার দিক থেকে সৌদি সেনাবাহিনীর বিশাল ঘাটতি রয়েছে। এমন সীমাবদ্ধতায় এক ধরনের হতাশা থেকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স চাচ্ছেন তার দেশেই অস্ত্র উৎপাদন হোক।
ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বলেছেন, ক্যান্সার রোগীর যেমন কেমো প্রয়োজন, তেমনি সৌদি আরবে দুর্নীতি রোধে শক থেরাপি দরকার। তিনি সৌদি আরবে এমন একটি মানব শরীরের সাথে তুলনা করেন, যার সর্বত্রই ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং তা রোধে কেমোর মতো শক থেরাপি প্রয়োজন। উদ্যমশীল মানুষকেই তিনি সৌদি আরবের ক্ষমতায় দেখতে চান এবং যাতে আধুনিক সৌদি আরবের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। এমনকি শুধু অস্ত্র না কিনে তা যতটা সম্ভব সৌদি আরবে উৎপাদন করলে প্রায় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে দেশটি ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে কোটি কোটি ডলারের পরমাণু জ্বালানি চুক্তি করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। এসব লক্ষ্যে সেনাবাহিনীতে রদবদল ও সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। মিসর, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর এসব বিষয় নিয়ে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক পরামর্শক গ্রুপের বিশ্লেষক থিয়েডোর কারাসিক একই অভিমত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিরক্ষা সজ্জা ছাড়াও ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌদি আরবের অস্ত্রসজ্জার অংশ হিসেবেই দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরো দক্ষ ও কার্যকর করে তুলতে এ ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। পরিবর্তনের এক বিরাট ক্ষুধা সৌদি প্রজন্মে যুগ যুগ ধরে রয়ে গেছে, তা এখন মেটানো অপরিহার্য এবং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো পরিবর্তনই সৌদি আরবে টেকসই হবে না এ হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন অনেকে।
ক্রাউন প্রিন্স অধিক কর্মসংস্থান, বিনোদন, অর্থনৈতিক প্রবদ্ধি, ধর্মীয় ও পুলিশের অতিরিক্ত কঠোর মনোভাব হ্রাসসহ ব্যবসায় বাণিজ্যের নিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছেন। সম্ভবত তিনি সৌদি তরুণ প্রজন্মের আকাক্সাকে ধারণ করার চেষ্টা করছেন।
এ জন্য সেনাবাহিনী প্রধান, মন্ত্রী, শীর্ষ সেনাকর্মকর্তা পরিবর্তনে ক্রাউন প্রিন্স পিছপা হচ্ছেন না। নারী কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দিয়ে তামাদুর বিনতে ইওসেফ আল-রামাকে উপ-শ্রমমন্ত্রী করা হয়েছে। একজন নারী এ মন্ত্রণালয়ে নারীদের কর্মসংস্থানে বিশেষ নজর দেবেন সেটাই চাচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স। দুর্নীতির দায়ে কয়েক মাস আটকের পর প্রিন্স তুর্কি বিন তালালকে মুক্তি দিয়ে উপ-গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আরব রাজনীতির অধ্যাপক মাহজুব জুইরি বলেন, সন্দেহ নেই ইয়েমেন যুদ্ধে নেতৃত্ব ও প্রশাসন কিংবা সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক রদবদলের মধ্য দিয়ে ক্রাউন প্রিন্স ধারণার আগেই সৌদি আরবের বাদশাহ হয়ে উঠছেন। এ জন্য সৌদি আরবের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন টের পাওয়া যাচ্ছে। বাদশাহ সালমান নিজ হাতে ক্রাউন প্রিন্সের জন্য পরিবর্তনের এ পাটাতন তৈরি করে দিয়েছেন, যার ওপর ভিত্তি করেই মোহাম্মদ বিন সালমান তার দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিশাল নির্মাণ কর্মযজ্ঞ শুরু করতে যাচ্ছেন।
তবে ইয়েমেন যুদ্ধ ২০১৫ সালে শুরু হওয়ার পর বিপুল বেসামরিক লোক হতাহত ও এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশটিতে দুর্ভিক্ষময় পরিস্থিতিতে আটকে থাকার পরও উন্নয়ন ও পরিবর্তন দিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সৌদি আরবের সমালোচনা কতটা দূর বা ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
প্রিন্স তুর্কি বিন তালাল নিজেও মনে করছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নিজেকে এক শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর করার রাজনৈতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এত ব্যাপক পরিবর্তন করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো জেমস ডরসে মনে করেন, ক্রাউন প্রিন্স বোঝাতে চাচ্ছেন; তিনি তাদেরই একজন। নতুন ধারার চিন্তা অনুসরণে সবাইকে বাধ্য করতে চাচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স। কিন্তু তিনি তা করছেন এক ব্যক্তির শাসনের মতো, সবার মতামতের ভিত্তিতে নয়।
হ্যাঁ, সৌদি আরবে দেখা যাচ্ছে নারীরা তার পছন্দের গাড়ি কিনছেন, মাঠে দর্শকের সারিতে বসে খেলা দেখছেন, জিমে যাচ্ছেন, কনসার্টে হৈ-হুল্লোড় করছেন, খাবার দোকান চালাচ্ছেন নারীরা। ইপসসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৭৪ শতাংশ সৌদি নাগরিক তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। মনে করছেন, দুর্নীতি, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এভাবেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সম্ভব হবে। কিন্তু জনগণের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ শাসনব্যবস্থায় যে গণপ্রতিনিধির অংশগ্রহণ তার অনুপস্থিতি থেকেই যাচ্ছে।
বিশ্বাসীদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করার কথা নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে ক্রাউন প্রিন্স জানিয়েছেন। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ সামরিক বাজেট বরাদ্দ দিচ্ছেন। সেনাবাহিনীকে কমপক্ষে ২০টি সেরা আসনে নিতে চাচ্ছেন। দুর্নীতির ক্যান্সার সৌদি অর্থনীতিকে সারা শরীরের মতো খেয়ে ফেলছে বলে তিনি শক থেরাপির কথা বলছেন। আটকদের মধ্যে ৫৬ জন ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মোহাম্মদ বিন সালমানের উন্নয়ন সারথী হিসেবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু যে সব দেশ এ ধরনের সফলতা অর্জন করেছে, তারা তো জনগণের শাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করেই তা করেছেন। সৌদি আরবে এর ব্যতিক্রম কী করে সম্ভব।
আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সউদ তা যদি করতেই পারতেন, তাহলে দেশটি দুর্নীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ল কিভাবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ক্রাউন প্রিন্স বলেছেন, কারো পক্ষে নতুন করে স্মার্ট ফোন তৈরি করা সম্ভব নয়, স্টিভ জবস ইতোমধ্যেই তা করেছেন। আমরা যা করছি তা হচ্ছে নতুন কিছু একটা করতে। পশ্চিমা মডেল তা করতে গিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স। মাঝখান থেকে উদ্যোক্তা বিকাশের ভিত্তি গড়ে ওঠার পরিবর্তে, উৎপাদনশীল অর্থনীতির পরিবর্তে ‘বাবল ইকোনমি’র সুযোগে বিশাল পুঁজি ও লভ্যাংশ সরিয়ে নেয়ার একটা পাকাপোক্ত ধান্ধার সুযোগ করে নিচ্ছে পশ্চিমারা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা