২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজউক ও দুর্নীতি এখন সমার্থক : টিআইবি

টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান : নয়া দিগন্ত -

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এখন এমন একটা ধারণা করা হয় যে, রাজউক আর দুর্নীতি সমার্থক। রাজউক এত দিনেও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। এমনকি রাজউক নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠানও নয়। রাজউকের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যে দায়িত্ব অর্পিত, তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ড্যাপ ও ডিএমডিপি রক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাজউক এখন তার মূল ভূমিকা থেকেই সরে গেছে। তাই রাজউকের দুর্নীতির বিষয়গুলো দুদকের গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। গতকাল বুধবার টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো: জুয়েল মিয়া। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা বাদ দিয়ে রাজউক এখন মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের নামে মুনাফা অর্জন এবং নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা আলাদা করতেই হবে। দীর্ঘ দিনের চর্চার ফলে রাজউকের ব্যবসায়িক মানসিকতা যেহেতু আর বদলানো যাবে বলে মনে হয় না, তাই আইনের যথাযথ সংশোধন করে রাজউকের সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক, নিরপেক্ষ এবং পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও প্রভাবমুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজউকের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে নিয়মবহির্ভূত অর্থ নেয়া হয়। জরিপের সময়ও চুক্তিভিত্তিক নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এর পরিমাণ দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছাড়পত্র অনুমোদনে ব্যক্তিপর্যায়ে ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। সেবাগ্রহীতারা ইমারত নকশা অনুমোদনের সেবা গ্রহণেও নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। ব্যক্তিপর্যায়ে ১০ তলা পর্যন্ত ইমারতের নকশা অনুমোদনে ফির অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। আবার ১০ তলার ঊর্ধ্বে ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফির অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বৃহদায়তন বা বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। নাগরিক সনদ ও বিধিমালা অনুয়ায়ী নকশা অনুমোদনের নির্ধারিত সময় যথাক্রমে ২০ দিন ও ৪৫ দিন হলেও সে অনুযায়ী অনুমোদন না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণত চার মাসে নকশা অনুমোদন হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে অর্থের পরিমাণ বেশি হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও কাজ সম্পন্ন হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে, বিভিন্ন প্রকল্পে সেবাগ্রহীতাদের প্রতারণা ও হয়রানির অভিযোগ আছে। প্লট বরাদ্দ, প্লট হস্তান্তর, ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর, প্লট মালিকের নথিভুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন পরিষেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সেবার ধরনভেদে দুই হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ না দিলে অযথা সময়ক্ষেপণ করে গ্রাহককে হয়রানি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য আইন, প্রাতিষ্ঠনিক সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচারসংক্রান্ত ১৪ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : আইন ও বিধিমালার সময়োপযোগী সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি যুগোপযোগী ও সমন্বিত আইন প্রণয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম হলোÑ ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২-এর আওতায় নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়নে নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তি বৃদ্ধি করতে হবে এবং ইমারত ব্যবহারের আগে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নেয়ার জন্য জরিমানা ধার্য করতে হবে; ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮-এর আওতায় বহুতল ভবনের সংজ্ঞায়নে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে ছয় তলার ঊর্ধ্বে নির্মিত ইমারতকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে; ঢাকা উন্নয়ন ট্রাস্ট (ভূমি বরাদ্দ) বিধিমালা, ১৯৬৯-এর আওতায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা যেন ন্যায্যভাবে প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রাখতে হবে; প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাজউকের সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক, নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও প্রভাবমুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে; মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কমিটির ড্যাপ রিভিউ কার্যক্রম বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে ডিএমডিপির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধন সাপেক্ষে অবিলম্বে ড্যাপ চূড়ান্ত করতে হবে; ইমারত নকশা অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সব নকশা (স্থাপত্য, নির্মাণ, কাঠামো ও সেবাসংক্রান্ত) সুনির্দিষ্ট মাপকাঠির ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষাপূর্বক অনুমোদন করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিতে রাজউকের সেবাকার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে এবং দালালদের হয়রানি বন্ধ করতে কার্যকর মনিটরিং-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্তভাবে পুনর্গঠন করে রাজউকের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে সেই কমিটিকে কার্যকর করতে হবে। শুদ্ধাচার নিশ্চিতে প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement