২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সরিষায় ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবেলায় বিনার ফর্মুলা

উত্তরাঞ্চলের ক্ষেতে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। রংপুরের নাজিরেরহাট থেকে তোলা ছবি : নয়া দিগন্ত -

সরিষা আবাদের মাধ্যমে দেশে ছয় লাখ টন ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবেলা করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিনার বিজ্ঞানীদের ফর্মুলা কাজে লাগাতে পারছে না সরকার ও কৃষি বিভাগে। ফলে সরিষায় চাষিদের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের কার্যকর উদ্যোগ এবং তদারকি না থাকা সত্ত্বেও দেশের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের চাষিরা আলুর পর সরিষা চাষের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন কৃষি বিভাগের বগুড়া জোনের সিরাজগঞ্জ জেলার চাষিরা।
সরেজমিন অনুসন্ধান, কৃষি বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন জরিপ রিপোর্ট ও সূত্র বলছে, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ষোল জেলায় কমবেশি পৌনে তিন লাখ হেক্টর করে জমিতে আলু আবাদ করছেন চাষিরা। বাম্পার ফলনও হচ্ছে। কিন্তু মাঝে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দাম না পাওয়ায় ব্যক্তি, বরগা, বন্দকি, লিজি আলু চাষি এবং ব্যবসায়ীরা ধরাশয়ী হয়ে পড়েন। আগের বছরগুলোর লাভ ভাঙিয়ে তারা এব ছরও আলু আবাদ ধরে রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আলুর আবাদ এবং দাম স্থিতিশীল রাখার উপায় নিয়ে ভাবনা হচ্ছিল সর্বত্রই। এই অবস্থায় পাঁচ বছর আগে পরিমিত পরিমাণ জায়গায় আলু এবং বাকি জায়গায় সরিষা চাষ করে আলুর বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার একটি কার্যকর ফর্মুলা দেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিনার একদল বিজ্ঞানী। সরিষার মাধ্যমে আলুর ক্ষতি পোষানোর গ্যারান্টির ফর্মুলাও দেন বিনার গবেষকরা।
অনুসন্ধান বলছে, আলুর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রংপুরসহ উত্তরের চাষিরা গত ছয় বছর থেকে ক্রমেই সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। প্রথমে বিনাধান-৭, এরপর বিনাসরিষা-৭ এবং সবশেষে বোরোধান- এই শস্য বিন্যাস অনুসরণের মাধ্যমে সরিষার চাষ করে খুব কম সময়ে ভালো ফলন পাওয়ায় আশাবাদী কৃষকরা। আমন মওসুমে আষাঢ় মাসে আগাম জাত বিনাধান-৭ এর চাষ করে আশ্বিন শেষের দিকে কর্তন করে সাফল্যজনকভাবে বিনাসরিষা-৭ চাষ করা যায়। সরিষা কর্তন করে স্বাভাবিকভাবেই বোরো ধানের চাষ করা যায়। এতে আমন এবং বোরো ধানের ফলনও ভালো হয়। বিনার সরিষার একর প্রতি ফলন ২৮ মণ এবং গড় ফলন হয় ২২ মণ। প্রতি মণ সরিষা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হওয়ায় একরে ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন চাষিরা।
বিনার গবেষক দল নয়া দিগন্তকে জানান, আমন আলু বোরোর পরিবর্তে আমন সরিষা বোরো শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের জাত সঠিক সময়ে চাষ করে উন্নত সরিষার জাত আবাদ করা সম্ভব। এর পরে লাগাতে হয় বোরো। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর শস্য বিন্যাস বিনাধান-৭-বিনাসরিষা-৭-বোরো। এই শস্য বিন্যাসকে জাতীয়ভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগের কথা বলছেন উদ্ভাবকরা। কিন্তু সরকার ও কৃষি বিভাগ বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ না দেখানোয় কৃষকরা নিজেরা নিজেরাই যতটুকু এগুচ্ছেন, ততটুকুই। ফলে সরিষার আবাদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টি উপেক্ষিতই থাকছে।
তেলের ঘাটতি পূরণ: বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিনা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে তেলের চাহিদা ৬ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু দেশে তেল উৎপাদন হয় মাত্র ১ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতি থাকে ৪ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন। তেলের এই বিশাল ঘাটতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবন করেছে অগ্রগামী বিনা সরিষার জাত।
উদ্ভাবক গবেষক দলের প্রধান বিনার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্রধান সরিষা গবেষক) ড. আব্দুল মালেক
নয়া দিগন্তকে জানান, দেশে আমন ধান আবাদযোগ্য ৫৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে স্বল্প জীবনকালের বিনাধান-৭ চাষের পর সেসব জমিতে বিনার উদ্ভাবিত সরিষা চাষ করে ৬ লাখ টন তেল উৎপাদন সম্ভব। যার মাধ্যমে একদিকে দেশে তেল ঘাটতি পূরণ হবে। অন্যদিকে সাশ্রয় হবে ৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি তেল রফতানিকারক দেশের তালিকায় নাম উঠবে বাংলাদেশের।
উদ্ভাবক গবেষক দলের অন্যতম বিনার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গবেষণা সমন্বয়ক ড. এম রইসুল হায়দার জানান, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে আলুর উৎপাদন হয় প্রচুর। তাই আলু চাষ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। চাষিরা একাধারে আলু চাষ করার কারণে আলু দাম পড়ে গেছে। লোকসানের মুখে পড়ে তারা এখন দিশেহারা। এজন্যই এই সময়ে সরিষা চাষ খুবই প্রয়োজন। চাষিরা যদি কিছু জমিতে সরিষা এবং কিছু জমিতে আলু চাষ করে তাহলে তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আলুর বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ হবে। তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদি জাতের সরিষার আবাদ কৃষকদের কাছে সম্প্রসারণ করতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে এই বীজের পর্যাপ্ত সাপ্লাই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় সরিষার এই সম্ভাবনা মাঠে মার খাচ্ছে। এজন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি এই গবেষকের।
বিনার রংপুর উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকতা মো: তানজিলুর রহমান মণ্ডল নয়া দিগন্তকে জানান, এ পর্যন্ত বিনা ১০টি সরিষার উন্নত জাত আবিষ্কার করেছেন। এরমধ্যে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বেশি চলছে বিনা সরিষা ৪, ৯ ও ১০। এরমধ্যে আমরা রংপুর বিভাগে ৫৬ একর জমিতে প্রদর্শনী প্লট করেছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকেও প্রায় ১০০ টি প্রদশর্নী প্লট করা হয়েছে। এছাড়াও কুড়িগ্রামের একটি এনজিওর সাথে আমরা কাজ করছি। তারা প্রায় ১১শ বিঘা জমিতে আমাদের জাতের সরিষা আবাদ করেছে। সরিষা আবাদে শস্য নিবিড়তার কারণে কৃষকরা চাষে আগ্রহী হচ্ছে। এ ছাড়াও আমরা সরিষার জমি থেকে মধু সংগ্রহের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করছি। এতে অতিরিক্ত ১৫ ভাগ ফলন পাওয়ার পাশাপাশি কৃষক বেশি লাভবান হয়।
উত্তরে বিস্ময়কর সরিষা বিপ্লব: গবেষকরদের এমন সম্ভাবনাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। গত পাঁচ বছর থেকে তারা প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। এ কারণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরিষার আবাদ। পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে সেই তথ্য। রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে রংপুরসহ উত্তরের ষোল জেলায় ১ লাখ ৩২ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। এই পরিমাণ ২০১৩ সালে এক লাফে উঠে দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৭৮ হেক্টরে। ২০১৪ সালে সরিষার আবাদ হয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪ হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে আবাদ হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাড়ায় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭২০ হেক্টরে। ২০১৮ সালে তা আরো বেড়ে দাড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪০ হেক্টরে।
সরেজমিন দেখা গেছে, দিগন্ত বিস্তৃত জমি থেকে সরিষা বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। আর মাসখানেকের মধ্যে সমস্ত সরিষা কৃষকের বাড়ির উঠোনে যাবে। শুরু হবে মাড়াই ও বিকিকিনির ধুম। তারপর সরিষার জমিতে বোরো লাগানো শুরু করবেন চাষিরা।
কৃষি বিভাগের বগুড়া জোন সরিষা চাষে বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে ইতোমধ্যেই। খামারবাড়ি বগুড়া জোনের অতিরিক্ত পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বগুড়া জোনের চার জেলা সরিষা চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এবার এই জোনে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। স্থানীয় বীজ দিয়েও সরিষার আবাদের পাশাপাশি বিনা ও বারি উদ্ভাবিত জাতের সরিষা লাগাচ্ছেন চাষিরা। আমরা চাষিদের সকল ধরনের সহযোগিতা দান অব্যাহত রেখেছি।
সরিষা আবাদে উত্তরাঞ্চলের মধ্যে কৃষি বিভাগের বগুড়া জোনের পরেই আছে রাজশাহী জোন। এই জোনের অতিরিক্ত পরিচালক এসএম মুস্তাফিজুর রহমান জানান, তার রিজিয়নের চারজেলায় সরিষার আবাদ ক্রমেই বৃদ্ধি হচ্ছে। এ বছর কৃষি বিভাগের রাজশাহী রিজিয়নে ৬৮ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বছর এই জোনে আবাদ হয়েছিল ৬১ হাজার ২২৬ হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, সরিষা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে আমার অঞ্চল অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে রংপর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম জানান, প্রতি বছরই টার্গেটের চেয়েও বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হচ্ছে। ফলন ভালো হওয়ায় এবং আলুর বিকল্প হিসেবে কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এবার রংপুর জোনের ৫ জেলায় ৩২ হাজার ৮৭৮ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। যা গতছরের চেয়ে বেশি।
এদিকে দিনাজপুর খামার বাড়ির অতিরিক্ত পরিচালক শামীম আহমেদ নয়া দিগন্তকে জানান, সরিষা আবাদে চাষিরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছেন। এবার দিনাজপুর জোনের তিন জেলায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। বিনার পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সরিষা আবাদ করতে পারলে তা দিয়ে ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবেলার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন চাষিরা বলে মনে করেন এই কৃষিবিদ।
আঞ্চলিক কৃষি অফিস গুলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে এবছর এই অঞ্চলে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হবে। গত বছরের মতো বাজার থাকলে যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে ৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওপরে। যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে করবে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমি সরিষা আবাদের উপযোগী। পরিকল্পিতভাবে এই সরিষা চাষ করতে পারলে উত্তরাঞ্চল থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement