২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নীরব ঘাতক রোগ 'হাইপারটেনশন'

কিছু রোগ আছে উপসর্গ ছাড়াই প্রকাশ পায়, এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম - সংগৃহীত

নীরব ঘাতক রোগ সেটিই, যা রোগের পূর্বাভাষ দেয় না; অর্থাৎ বেশির ভাগ রোগেরই উপসর্গ নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যান। কিছু রোগ আছে উপসর্গ ছাড়াই প্রকাশ পায়, এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। এক তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি আটজনের মৃত্যুর মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে।

উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়?
৯০-১০০ জনের কারণ জানা যায় না। ৫-১০ জনের কারণ জানা যায়। যাদের কারণ জানা যায়, সেই কারণগুলোর চিকিৎসা সঠিকভাবে করা যায় না। মেডিক্যাল সায়েন্সের ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপের সব রোগীর কারণ খুঁজে বের করা কোনো দিনই সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি না। আশার কথা হচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপের যেটিই কারণ হোক। সঠিক ওষুধ দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই অসম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, উচ্চ রক্তচাপ কী? হ্যাঁ, যখন শরীরের রক্তবাহী শিরার চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় এবং তা স্থায়ী হয় তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে।

ক) স্বাভাবিক রক্তচাপ : ১২০/৮০ মিমি. অব মার্কারির নিচে। মানবভ্রুণ মাতৃগর্ভে তিন সপ্তাহ পর থেকে হার্টের কার্যক্রম শুরু করে, যা আমাদের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত প্রবাহিত করছে; এই সঙ্কোচনকে বলা হয় সিস্টল। আর যখন হৃৎপিণ্ড প্রসারিত হচ্ছে তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্ত হার্টে ফিরে আসছে। সেটিকে বলা হয় ডায়াস্টল। ওপরের রক্তচাপকে বলা হয় সিস্টলিক ব্লাডপ্রেসার আর নিচেরটিকে বলা হয় ডায়াস্টলিক ব্লাডপ্রেসার।

খ) উচ্চ রক্তচাপের পূর্বাভাস : ১২০-১৩৯/৮০-৮৯ মিমি. অব মার্কারি। এই প্রেসারে রোগীদের সাধারণত প্রেসার কমানোর ওষুধ দেয়া হয় না। তাকে কিছু বিধিনিষেধ দেয়া হয়। যেমন- পাতে কাঁচা বা ভাজা লবণ খাবেন না। লবণযুক্ত খাবার যেমন- চানাচুর, লবণযুক্ত বিস্কুট, পনির, বোরহানি, লবণযুক্ত শুঁটকি খেতে নিষেধ করা করা হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে অ্যাংজিওলাইটিক ওষুধ কিছু দিনের জন্য দেয়া হয়। মাঝে মাঝে প্রেসার চেক করতে বলা হয়।

গ) উচ্চ রক্তচাপ : স্টেজ-১: ১৪০-১৫৯/৯০-৯৯ মিমি. মার্কারি
স্টেজ-২: ১৬০/১০০-এর ওপরে

উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের প্রেসারের ওষুধ চলবে লিখে দেয়া হয়। এ ওষুধ নিজে নিজে বন্ধ করা যাবে না। ডোজ কমানো-বাড়ানো যাবে না চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ :
- বংশগত কারণে বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ছেলেমেয়েদের উচ্চ রক্তচাপ হবেই বলা যাবে না। তবে হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অলস জীবনযাপন এবং যারা মানসিক উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

- যারা ভোজনাধিক্যে ভুগছেন, যারা মদপান করেন তাদের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। ডায়াবেটিস, যারা বেশ কিছু কিডনি রোগে ভোগেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। আবার কিছু হরমোনজনিত রোগে ভোগেন তাদের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

- যারা পাঁচ বছরের বেশি জন্মবিরতি পিল, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ, বেদনানাশক ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি সেবন করেন। তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

- গর্ভবতী মহিলা গর্ভের পাঁচ মাস পর থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। প্রতি দু’জনে একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের রোগ সম্পর্কে জানেন না। দেশে কতজন উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে ভুগছেন তার সঠিক তথ্য নেই। তবে একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, শহরের ১৫-১৮ শতাংশ, গ্রামে ১০-১৫ শতাংশ; অর্থাৎ ১-১.৫ কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এদের শতকরা ৭০ ভাগ রোগী জানেন না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ৩০-৭০ বছর বয়সের মধ্যে যে কেউ যেকোনো সময় উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। গবেষণা মতে, মাত্র ১০ শতাংশ রোগী উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিয়মিত সেবন করেন।

উচ্চ রক্তচাপ হলেই যে সবার মধ্যে উপসর্গ দেখা দেবে, সেটি না-ও হতে পারে। সে কারণেই এটিকে নীরব ঘাতক রোগ বলা হয়। হয়তো যেকোনো রোগের কারণে চিকিৎসকের কাছে এলেন। চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করলেন- উচ্চ রক্তচাপ। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

উপসর্গগুলো
- মাথার পেছন দিকে ব্যথা করে
- সকালের দিকে এবং হাঁটাচলার সময় ব্যথার তীব্রতা বাড়ে
- কারো ক্ষেত্রে মাথা গরম অনুভব করেন
- স্মরণশক্তি কমে যাওয়া
- কাজকর্মে আগের মতো মনোনিবেশ করতে না পারা
- অনেকের মাথা ঘোরে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, বুক ধড়ফড় করে, বুকে চাপ অনুভব ও চোখে ঝাপসাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ সঠিকভাবে ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে বেশ কিছু জটিলতা যেমন- হৃদরোগ, হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া, হার্টফেইলিউর অর্থাৎ হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কিডনি রোগ জটিলতা, স্নায়ুদুর্বলতা ও চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ হলে-
চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ সেবন করবেন। এক-দুই সপ্তাহ অন্তর রক্তচাপ মাপাবেন। রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে গেলেও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। নিজের ইচ্ছামতো কখনো ওষুধ বদল করা যাবে না। অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ওষুধ সেবনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে।

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটুন। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ধূমপান থেকে বিরত থাকুন, লবণযুক্ত ও তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত ও পরিমিত ব্যায়াম করুন। পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার, রসুন ও পরিমিত মাছ খাবেন। সর্বোপরি দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন যাপন করুন।


আরো সংবাদ



premium cement