২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৭০ হাজার টাকা ও লিভার বদলে যাওয়া

লিভা আক্তার - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল মানেই গরিব ঘরের মেয়েদের অসামান্য অবদান। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মহিলা ফুটবল দল আজ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখে। অথচ এই মেয়েদের কত কষ্ট আর কী মারাত্মক প্রতিবন্ধকতাই না ডিঙ্গিয়ে আসতে হয়েছে এই মহিলা ফুটবলে।

তেমনই এক ফুটবলার লিভা আক্তার। দুই পর্ব মিলে এই ফুটবলারের ২৭ গোলের (লিভার দাবি ২৯ গোল) উপর ভর করে এবারের বাফুফে-ইউনিসেফ অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লালমনিরহাট জেলা। লিভা পেয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার।

ভারতীয় সীমান্তে কাছে প্রত্যন্ত প্রাণকৃষ্ণ গ্রামের টেপুরগাড়ী স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী লিভাকে এক সময় তার মা মারধর করেছিলেন ফুটবল খেলার অপরাধে। বাবাও খুব বকাঝকা করতেন। প্রবল আপত্তি ছিল নিকটআত্মীয় স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদেরও। তাদের নেতিবাচক মন্তব্য। অথচ এখন সবাই লিভার পক্ষে। তারা চাচ্ছেন লিভার মতো অন্যরাও ফুটবলে আসুক। লিভার বাবা-মা তো অপর মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে ফুটবলে দিয়েছেন। এবারের চ্যাম্পিয়ন লালমনিরহাট দলের খেলোয়াড় তিনিও।

হঠাৎ সবার লিভার ফুটবলের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণ ২০১৮-এর বঙ্গমাতা ফুটবল। সেই আসর থেকে এই ফুটবলারের পুরস্কার হিসাবে অর্জন ৭০ হাজার টাকা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার ফলে ৩০ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা পান লিভা। সাথে আরো ১০ হাজার টাকা। তা রানার্সআপের প্রাইজমানির অংশ হিসেবে।

লিভা এই টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আনন্দের বন্যা বয়ে যায় দরিদ্র কৃষক বাবার মতিউর রহমানে পরিবারে। লিভা বলেন, ‘আমি ফুটবল খেলে এত টাকা পেয়েছে- এটা তাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বাবা-মায়ের বক্তব্য ছিল, তুমি ফুটবল খেলে এত টাকা পেয়েছে! যাও এখন থেকে তুমি নিয়মিত ফুটবল খেলবে।’

এই ফরোয়ার্ড জানান, ‘অথচ আগে এক দিন ফুটবল খেলে বাড়ি ফেরার পর মা আমাকে খুব মেরেছিলেন কেন ফুটবলে গেছি। মায়ের বক্তব্য, মেয়েদের ফুটবল খেলা ভালো না। এ ছাড়া আশপাশের ছেলেরা ফুটবলে খেলার জন্য আমিসহ অন্যদের ‘ভাইজান’ বলে টিটকারি মারত; কিন্তু আমি দমে যাইনি। বলেছি ফুটবল আমি খেলবই।’

লিভার দেয়া সেই টাকায় কাঁচা বাড়িতে দেয়াল তুলেছেন বাবা মতিউর রহমান। এখন বাড়িটির পাশে দেয়াল আর উপরে টিন। তবে তাদের বাড়িতে কোনো টেলিভিশন নেই। লিভা জানান ‘আমাদের দলের মাত্র একজন মেয়ের বাড়িতে টিভি আছে।’

কোচ আলিম আল সাঈদ খোকনের দেয়া তথ্য পুরো ১৬ জনের স্কোয়াডে একজন ছাড়া বাকি সবাই নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। কারো বাবা রিকশা চালায়, কারো বাবা ভ্যানচালক। পেশায় কৃষক এমন অনেকের বাবা। রীতিমতো যুদ্ধ করে প্রতিকূল পরিবেশের বিপক্ষে কাজ করে তাদের আমি ফুটবলে এনেছি। এমনও গরিব ফুটবলার আছে, যাদের দুই বোনের একজোড়া মাত্র স্যান্ডেল। তারা মাঠে কৃষি কাজ করে এক বেলা।’

প্রথম শিরোপা লালমনিরহাটের
রেফারি ময়নুল ইসলাম জনির শেষ বাঁশি। এর পর দুই দলের ফুটবলারদের চোখেই পানি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মাগুরার মেয়েরা। আর হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেন লালমনিরহাটের খেলোয়াড়রা। মাগুরার মেয়েদের কান্নাটা যুক্তিযুক্ত। তাদের যে চ্যাম্পিয়ন হওয়া হলো না; কিন্তু শিরোপা জিতেও কেন লালমনিরহাটের ফুটবলারদের এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া। তাদেরকে কান্না থামানোর ধমক দিয়ে গিয়ে কোচ আলিম আল সাঈদ খোকনের চোখেও চলে আসে পানি। তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে থাকেন মেয়েরা। তাদের এই অবস্থা আনন্দের। প্রথম শিরোপা জয়ের চূড়ান্ত আবেগের বহিঃ প্রকাশ। লালমিনরহাট জেলা যে প্রথম বাফুফে-ইউনিসেফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন দল।

কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ফাইনালে মাগুরাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয় করে লালমনিরহাট জেলা। হ্যাটট্রিক করেন লিভা আক্তার। এ ছাড়া সান্ত্বনা খাতুন করেন অপর গোল। চ্যাম্পিয়ন দলকে ৫০ হাজার টাকা ও ট্রফি এবং রানার্সআপ দলকে ২৫ হাজার টাকা ও ট্রফি প্রদান করা হয়। টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন লালমনিরহাটের মুনকি আক্তার। সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন একই দলের লিভা আক্তার। সেরা উদীয়মান ফুটবলার লালমনিরহাটের গোলরক্ষক গোলাপী আক্তার।

এই আসরের সেরা দুই দলই খেলেছে ফাইনালে। তবে ফাইনালে আর পেরে ওঠেনি মাগুরা জেলা। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে গোল আদায় লালমনিরহাটেরর। পিছিয়ে পড়ার পর ছন্নছাড়া মাগুরা জেলা। তাদের ডিফেন্স ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে গোলের সংখ্যা বাড়িয়ে জয় ও শিরোপা নিশ্চিত করে লালমনিরহাট। লালমনিরহাটের দলটি গত বছর বঙ্গমাতা আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবলে রানার্সআপ হওয়া টেপুরগাড়ী পিকে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের খেলোয়াড়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদের অভিযোগ ওই ফাইনালের আগে তার দলের খেলোয়াড়দের ইচ্ছে করে বাদ দেয় ময়মনসিংহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তা না হলে তার স্কুলই চ্যাম্পিয়ন হতো। অবশ্য টেপুরগাড়ী স্কুল ২০১৬ সালের বঙ্গমাতায় চ্যাম্পিয়ন।

এবার লালমনিরহাট ৪৫ দিনের অনুশীলন করে ইউনিসেফ অনূর্ধ্ব-১৬ আসরে অংশ নেয়। দলটির বড় অর্জন শিরোপা জয়ের পাশাপাশি তারা এবারের আসরে কোনো গোল হজম না করা। তথ্যটি দেন কোচ খোকন। তিনি রংপুর শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লালমনিরহাট গিয়ে এই মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মাগুরার কোচ শহীদুল ইসলাম চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার জন্য প্রথমে গোল মিস এবং পরে পিছিয়ে পড়ার পর ফুটবলারদের নার্ভাস হয়ে যাওয়াকে দায়ী করলেন।

ফাইনালে উপস্থিত ইউনিসেফ কর্মকর্তা সিমন পিককফ জানালেন, তাদের ভবিষ্যতে মহিলা ফুটবল দলের পাশাপাশি পুরুষ ফুটবল দলকেও স্পন্সর করার পরিকল্পনা আছে।


আরো সংবাদ



premium cement