২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ত্রিমুখী সঙ্কটে দেশ ডেঙ্গু-বন্যা গণপিটুনি

-

ত্রিমুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশ। ডেঙ্গু ও বন্যার দুর্যোগের সাথে ছেলেধরা গুজবে সর্বত্র আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ডেঙ্গুর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এ কারণে ছেলে-বুড়ো থেকে সব বয়সীদের মনে ভয়ভীতি দানা বেঁধে উঠেছে। বিভিন্ন উদ্যোগের পরও পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। একসাথে এভাবে তিনটি সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারও দিশেহারা।
ডেঙ্গু : রাজধানীসহ সারা দেশে এডিস মশাজনিত রোগ ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। বিছানায় জায়গা না পেয়ে ফ্লোর এমনকি সিঁড়িতেও ঠাঁই নিতে হচ্ছে রোগীদের। আর রোগীদের সাথে স্বজনদেরও যেন ঘুম নেই। রাত জেগে রোগীদের সেবা করতে হচ্ছে। আবার কাউকে রক্ত সংগ্রহে এখানে ওখানে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে এখন এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এক হাজার ৯৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
এ দিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর শেষ হতে এখনো পাঁচ মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় দেড় যুগ আগে ২০০২ সালে দেশে সর্বোচ্চ ছয় হাজার ২৩২ জন আক্রান্ত হন। তবে ২০০০ সালে ৯৩ জনের মৃত্যুর রেকর্ডই ছিল সর্বাধিক। দীর্ঘ ১৬ বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে নতুন রেকর্ড করেছিল। মৃতের সংখ্যা ছিল ২৬। চলতি বছরের সাত মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৬৩৭। ফলে ২০১৮ সালের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড স্থাপিত হলো। শুধু তা-ই নয়, গত বছরের জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল পাঁচ হাজার ৫০ জন। এ বছর জানুয়ারিতে ৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৯, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৮৪, জুনে এক হাজার ৮২৯ ও জুলাইয়ে (২৮ জুলাই পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ১১ হাজার ৪৫০ জন।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার বাইরে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৮৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৩১ জন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা: আয়েশা আক্তার বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে চলতি বছরে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৬৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। তবে এ বছর মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ১০ জন। তবে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, চলতি মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা গত বছরের ২৬ জনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল কালাম আজাদ জানান, চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরই মধ্যে আক্রান্ত ১৩ হাজার ৬৩৭ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ১০ হাজার। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন হাজার ৮৪৭ জন। বাকি ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যা : এ মাসের শুরুতে দেশের ২৮টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যায় ২৮ জেলার ১৬৩ উপজেলা, ৪৯ পৌরসভা, ৯৬১ ইউনিয়ন এবং ছয় হাজার ৫৩টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৫ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৮ ঘরবাড়ি, এক লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৩ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৫টি গবাদিপশু, ২২ হাজার ৩৩৯টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে বন্যায়। এ ছাড়া চার হাজার ৯৩৯টি শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাত হাজার ২৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৯৭টি ব্রিজ বা কালভার্ট, ৪৫৯ কিলোমিটার বাঁধ, ৬০ হাজার ২৮৯টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি ও ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান গত রোববার জানান, বন্যাজনিত কারণে দেশের ১৪ জেলায় এ পর্যন্ত ৭৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি : টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার সয়া হাটে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার ভ্যানচালক মিনু ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার মারা গেছেন। গত ২১ জুলাই গণপিটুনির শিকার হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ দিন পর তার মৃত্যু হলো। নিহত মিনু ভূঞাপুর উপজেলার টেপিবাড়ী গ্রামের মৃত কোরবান আলীর ছেলে। শুধু মিনু নয়, সম্প্রতি পদ্মা সেতুতে অনেক মাথা লাগবে এমন অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ায় দেশের সর্বত্র ছেলেধরা গুজব দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে গণপিটুনি দেয়ায় বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে ছেলেধরা বলে অপপ্রচারের অভিযোগ উঠেছে। ফলে এক দিকে ছেলেধরা গুজবে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে অন্য দিকে মিথ্যা প্রচারণায় যেকেউ গণপিটুনির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় সবার মাঝেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। মূলত এ গুজব থামাতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে গণপিটুনিতে জড়িত শতাধিক ব্যক্তিকে আটকও করা হয়েছে। তার পরও আতঙ্ক বন্ধ হচ্ছে না। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে স্কুলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement