২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্যের ছাপাখানায়

-

যখন দেখবেন আপনার সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কাজেই সফলতা আসছে না। চেষ্টার পর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারপরও জট খুলছে না। অথচ আপনাকে প্রতিদিন আপনার সন্তানদের স্কুল যাতায়াতের খরচÑ বই, খাতা, পেন্সিল, ইরেজার, টিফিন খরচ মেটাতে হয়। প্রাইভেট শিক্ষকের বেতন, কাঁচাবাজার, মাছের বাজার, মুদি দোকানের খরচ, নিজের চলাচল, বৌ-বাচ্চার ওষুধপত্রের খরচসহ আনুষঙ্গিকÑ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল আপনি কিভাবে মেটাবেন? দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত আপনি বেকার। যা কিছু লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করার কথা ভাবছেন, সে পথও রুদ্ধ। লিখে যাচ্ছেন কেউ পড়ছে না, তারপর ছাপানো, ছাপিয়ে বাজারে ঢোকানো, পাঠককে ধরানো, পড়ানো, কামানো, জনপ্রিয় হবে কি হবে না? না কি গাট্টি হয়ে পড়ে থাকবে প্রকাশকের গুদামঘরে। এতসব অনিশ্চয়তার ভেতরে আপনি কতটা অসহায় একবার ভাবুন। অথচ দিন কেটে যাচ্ছে, জীবন থেমে নেই। যাপিত জীবনের খরচও দিনে দিনে পাগলা ঘোড়ার মতো বেড়েই চলছে। আপনি তখন নিরুপায় হয়ে ধার দেনার হাত পেতে যাচ্ছেন। দেনার হাত লম্বা হতে হতে বাসার সামনের মুদি দোকান থেকে মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা, স্কুলের বেতন, প্রাইভেট শিক্ষকের বেতন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলের টাকার সাথে আরো যোগ হওয়া আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে লোন নেয়া টাকার সাথে একাকার হয়ে জালের মতো বিস্তার করে আপনাকে চারদিক থেকে জেকে ধরেছে। আপনি তখনো চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। প্রতিদিন দরজায় পাওনাদারদের কলিং বেলের রিং বেজেই চলছে। ঘুম-নির্ঘুম রাতে বিছানায় লাফিয়ে উঠছেন, মাঝরাতে স্বপ্ন দেখছেন বৌ-বাচ্চার সামনে আপনাকে পাওনাদাররা অপমান করে যাচ্ছে। যে আপনি একসময় সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। বাতিঘর বীরবর্ন, চিড়িয়াখানার মতো চিত্রনাট্য লেখার পর নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, শাইখ সিরাজ, মাসুম রেজার মতো জাতীয় ব্যক্তিত্বরা যে আপনার লেখায় অন্যরকম জাগরণের সুর দেখেছিল। নাট্যকার সেলিম আল দ্বীনের মুগ্ধতা ছিল বীরবর্নে, চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানেরও। এদের আড্ডায় আপনার উচ্চারণগুলো ছিল যথেষ্ট প্রাণোদ্দীপক। সেই আপনার এহেন অবস্থা? আপনি যখন দেখবেন আপনার এক প্রতিভাবান বন্ধু প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। অথচ আপনি চেষ্টা করলে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তখন নিশ্চই আপনি আপনার সহজ সরল হাতখানা বাড়িয়ে দেবেন। তাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন, তার পরিচয় তুলে ধরবেন। কেননা, প্রতিভার মুল্যায়ন হলে, তার যথাযথ পরিচর্যা হলে, তাতে প্রচুর ফল হবে, ফলবান বৃক্ষও গজাবে।
যে সময় চলে গেছে সে ফিরে আসবে না। কিন্তু অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই জানান দিয়ে যায়। কেউ মনে রাখে কেউ রাখে না। কেউ পেছন ফিরে তাকায়, কেউ তাকায় না। কারণ একসাথে বহুদূর পথ হাঁটার পর ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পিছিয়ে যাওয়া বন্ধুকে যদি হাত বাড়াতে গিয়ে পিছিয়ে পড়তে হয়, তাহলে তো প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেকেই পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই খুব কাছের জনকেও আজ আর কেউ পেছন ফিরে কাছের জন ভাবতে অপারগ। সামনে যে বা যারা ছুটে চলছে, তাদের দিকেই হাত প্রসারিত করে আরো জোরে আরো সামনে ছুটে চলা। এভাবেই সামনের দিকে কিংবা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে ওঠার প্রতিযোগিতা চলছে অব্যাহত গতিতে। পেছনে যে বন্ধু আহত-ক্লান্ত, তার সাহায্য তো দূরে থাক, তার দিকে ফিরে তাকানোরও সময় নেই। ফলে পড়ে থাকা বন্ধুর সাথে সামনে উপরে ধাবমান বন্ধুত্বের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় সুদূর অচেনা অস্পষ্ট হয়ে রয়। এমনি এক দূরত্বে যখন আপনি অবস্থান করছেন, তখন আপনি কী করবেন? আপনাকে তখন নিশ্চয়ই গতিপথ বদলাতে হবে। বন্ধুরা যখন সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে, আপনি তখন লিফটে চড়তে পারেন। যান্ত্রিক কোনো যানে দ্রুত পাড়ি দিতে পারেন। এরকম আরো অনেক শর্টকাট ব্যবস্থাই আপনার সামনে খোলা। এসব পথের প্রতিযোগিতায় কতজনই তো শর্টকাট পথে কত জায়গায় চলে গেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি, চা বিক্রেতারা হয়ে গেছে কাউন্সিলর। অফিসের পিওন হয়ে গেছে কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। সাহিত্য পাতায় একে অপরে পিঠ চুলকে দিচ্ছে। বন্ধুত্বের খাতিরে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছে। রাজনীতির মঞ্চেও একই চুলকানির হাতছানি। একে অপরের পিঠ চুলকে প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছে। আদতে শেষমেশ কি হচ্ছে। জীবনের সহজ-সুন্দর, সাবলীল কথা, সমাজ বাস্তবতা থেকে সরে গেছে। আপনি যেতে চাচ্ছেন না সে পথে, আপনি বরাবরই প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চান। আপনি চাচ্ছেন আপনার কথা, আপনার সময় আপনার পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ বাস্তবতাগুলো যেন চারপাশে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। সেও যেন তার কথাগুল বলতে ভুলে না যায়। এভাবেই একে অপরের কথা দুঃখ-আনন্দের দৃষ্টিভঙ্গীগুলোকে কিভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। চারদিকের এসব আবেগ-অনুভুতির কথা জড়ো হতে হতে বিস্ফোরণ ঘটে যাক শব্দ, কথায়, বাক্যে। পৌঁছে যাক বইয়ের পাতায়, পাতা থেকে আড্ডায়, আড্ডা থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে, আন্তর্জাতিক বলয়ে। একপ্রান্তের মানুষ জানুক বিশ্বের আরেক প্রান্তের মানুষের কথা বাস্তবতা। মিলিয়ে নিক একে অপরের সুখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দ একে অপরের সাথে। বাধা আসবে অক্ষমদের থেকে। অক্ষমরা সবসময়ই তাদের অক্ষমতাকে ঢাকতে সক্ষমদের দলে ভেড়াবে। সক্ষমদের দ্বারা তারা তাদের অক্ষমতাকে প্রলেপ দিয়ে অক্ষমতাকেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানদণ্ড বানাবে। বিনিময়ে বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা এমনকি পুরস্কারও ভাগাভাগি করে দেবে। সক্ষম ব্যক্তিদের সুস্থ চিন্তার জায়গায় অসুস্থ ভোগ-বিলাস ঢুকিয়ে দেবে। মানুষকে ভাগ করে দেবে। রাষ্ট্রে সমাজে বিভক্তি তৈরি করবে, পরিবারে ভাই ভাই বিভক্ত হবে,স্বামী-স্ত্রীর সাথে, সন্তান বাবা-মায়ের সাথে বিভক্তি তৈরি করে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে প্রচার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট থাকবে। আতঙ্কে ভয় ধরিয়ে গৃহবন্দী করাকে বলা হবে নিরাপত্তা। নম্রতা-ভদ্রতাকে বলা হবে দুর্বলতা। হিংস্রতা ও পৈশাচিকতার নাম দেয়া হবে সাহসীকতা। সাহিত্যের বাজারে আজ তাই দেখি আঙ্গিককে ধারণ করে গল্পগুলো পৈশাচিকতায় বিরাজ করে নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় অবস্থান করছে। আবার সেসবের কাহিনীসংক্ষেপ তুলে ধরে এক ধরনের প্রচার তৈরি করে সেসব বাজার গরম করা সাহিত্যকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর সাথে বর্তমান সময়, এই সময়ের মানবিক জীবনযাত্রা, যুদ্ধ, হতাশা, বেঁচে থাকার আশা নিয়ে সীমান্তগুলোর খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা কেউ কোথাও নেই।
মানবতা আজ মানবেতর জীবনের কথা বলতে পারে না। তাদের কথা আটকে থাকে সীমান্তের কাঁটাতারে। আর যারা দেশ মাতৃকার কৃষক শ্রমিক হয়ে সভ্যতার চাকা ঘোরায় তারা সমাজের অস্পৃশ্য থেকে যায় শিল্প সাহিত্যে। তাদের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দগুলো খোলা চোখে কারো সাহিত্যে ধরা পড়ে না। যদিও বা কদাচিত চোখে পড়ে, তাও দুরবিন দিয়ে দেখা খাপছাড়া উপরি জগতের কোলাহল ব্যতীত কিছু নয়।
প্রেম মানে অশ্লীল উদ্ভট যৌবনের কথোপকথন। যার আমদানি-বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নামে কচলাকচলি নৃত্যগীতের কথ্যরূপ। আর পরিবার মানে একজন আরেকজনের দোষত্রুটি খুঁজে বের করা, ঝগড়া করা, সন্দেহ সৃষ্টি করে ঘর-সংসার ভাঙা, তারপর পশ্চিমাদের মতো পরিবার ভেঙে আমাদের সমাজে পরকীয়ার মতো বিষক্রিয়ার আমদানি করে হতাশার বীজ বপন করে ভালো সমস্তকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে ব্যক্তিমানুষকে একা করে দেয়া।
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য ছোট-বড় দুঃখ-বেদনা, হাসি-আনন্দের নাম যে জীবন। জীবনের এইসব মুহূর্তে একে অন্যের পাশে থেকে সহযোগিতা-সমর্মিতার হাত বাড়িয়ে যারা থাকে তারা ভাই-বোন, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসন্তুতি বন্ধু-আত্মীয়, পরিবার-পরিজন। অজানা অতিথির আপ্যায়ন, অধিনস্তদের ভরন-পোষণ, চলতি পথে একে অন্যের কষ্টের অংশীদার হয়ে তাকে কষ্ট থেকে উদ্ধার। এসবই আমাদের সহজ সাবলীল সমাজ ব্যবস্থার বিষয় আশয়। বিয়ে বাসরে মনের গহিনে সলজ্জ দৃষ্টি বিনিময়। দূরে কোথাও গেলে পথ চেয়ে বসে থেকে প্রিয় মানুষটিকে কল্পনার রঙে ভরিয়ে শূন্যতাকে পূর্ণতা দেয়া। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ফিরে এলে রঙে রঙ্গিন মন ভরিয়ে দেয়ার মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে আনন্দ অবগাহনের যাত্রা, সেইসব অনুরণনকে গলা টিপে ধরে মনের বাইরে চোখের ঝলকে দেখা, কানে, গানে, নাটক সিনেমার সংলাপে ভরিয়ে রেখে কৃত্রিমতার সুখ সৃষ্টি চেষ্টা হচ্ছে। ফাদারস ডে, মাদারস ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে নামক উত্তেজক সুখ নামের ভয়াবহ অসুখের তৈরি বিস্তার ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেই অসুখের ঢেউয়ে সংসার যাত্রা কিংবা যাপিত জীবনের বিশাল সমুদ্র সময়ে অন্তঃসার শূন্য হয়ে একই ছাদের নিচে দুজনই হাহাকার জীবন পার করছে। কেননা মুহূর্তের উত্তেজনাকে সাথে নিয়ে বিশাল সময়ের জীবনকে বয়ে চলা যাবে না। এই বোধ যখন আসে, তখনই মনে বিপত্তি ঘটে। সময় তিক্ত হয়। পরিতৃপ্তির পথ খোঁজে। আর সমাজ যখন তিক্ততা ছড়াতে থাকবে, তখন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে রাষ্ট্র-সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিরাজ করবে। তাতে করে একই ছাদের নিচে বসবাস করার পর এক পরিবার হয়ে না ওঠার মতো একই রাষ্ট্রব্যবস্থার অবকাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেও চেতনার জায়গা বিক্ষিপ্ত থেকে যাবে। তাই শিল্প সাহিত্যে দোষ খোঁজার জায়গাকে প্রাধান্য না দিয়ে, দোষের জায়গাগুলোকে গৌণ রেখে একত্রিত করার ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি। সমস্যা বের করা সহজ সমাধান কঠিন।
শিল্প-সাহিত্য যদি মানব মনের সমাজের সময়ের সমাধানের পথ খুঁজে দেয়, তাহলে সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন একই সাথে সমাজ বিজ্ঞানীও। এতে করে সাহিত্য যেমন বলবান হয়ে ওঠে, তেমনি মানুষও সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়ে ব্যক্তি, মানুষ, পরিবার ও সমাজের মানুষ হয়ে ওঠে শক্তিশালী। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সাহিত্যের কাজ কি তবে মানুষের জাগতিক সমস্যার সমাধান খোঁজা? না তা অবশ্যই নয়, আবার সাহিত্যের কাজ শুধু সমস্যা দেখিয়ে বেড়ানো? না, তাও না। সাহিত্য তার আপন গতির রসেই ভেজাবে তার গল্প কবিতা নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধকে। দোকানে দেখানো তৃপ্তিকর খাবারের লোভ লাগল, বললাম দর্শনে কিছুটা ভোজন হয়। এবার দর্শনে কিভাবে ভোজন হলো তার গল্প চলল। তারপর আরেকদল সেই খাবারের ঘ্রাণ নিলো এবং ঘ্রাণে অর্ধভোজন এই কথার উপরও গল্প চলল। পেট কিন্তু ক্ষুধার্তই রয়ে গেল। এইবার পেট ভরানো হল কিন্তু সেই তৃপ্তিকর খাবারে নয়। পেট ভরানোর নিমিত্তে খাবার দেয়া হলো। এই নিয়েও গল্প চলল পেট ভরল কিন্তু তৃপ্তি মিটল না, আফসোসটা থেকেই গেল। কিন্তু যখন তার মনের মতো সেই খাবারটা খাওয়ানো হলো, তাতে করে পেটও ভরল তৃপ্তিও মিটল। কিভাবে সেই খাবারটা খাওয়া হলো তা দিয়ে কিভাবে মনের খোরাক মিটল তার গল্পও চলল। তৃপ্তি নিয়ে খাবারের ব্যাপারটা বহুদিন চলল, লেগে থাকল জিহ্বায়, জেগে থাকল মনে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ সাহিত্যে আমদের সমাজের পরিবারের পরিচিত মুখগুলোর সুখ-দুঃখকে সুনিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। সহজ-সরল ভাষায় চরিত্রগুলোর উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে পরিচিত কষ্ট আনন্দের অনুভূতিগুলোকে জড়ো করে এদের মুক্তির পথ খুলে দিয়েছেন। যাতে করে ওইসব পাঠক পরিচিত ওইসব চরিত্রদের মাঝে বিদ্যমান দোষত্রুটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে আবার বের হওয়ার বাস্তবসম্মত সহজ পথের সন্ধান সান্ত্বনা পায় বলেই বুদ্ধিজীবীরা যতই তাকে ঔপন্যাসিক আর ফর্মা মাপা লেখক বলেন না কেন? পাঠকসমাজে তিনি দারুণভাবেই উত্তীর্ণ। কালের বিচারে এই সাহিত্য কতদিন টিকবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, কালই না হয় জানান দেবে কতদিন টিকে থাকবে? তবে হুমায়ূন সাহিত্য যে তরুণ, যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সবার আবেগে আদরণীয় স্থানে পৌঁছেছে এবং মুত্যুর পরও তার বই যেভাবে পড়া হচ্ছে তা বিস্ময়কর নয় বরং স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে হয়। আমাদের সমাজের ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমান ধর্মকর্ম রীতিনীতি সর্বদাই অবহেলিত। আর যতটুকুও বা আছে, তাও ভুল দেখায় ভুল ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ। যার দ্বারা মনের ভেতর নৈকট্য তৈরির পরিবর্তে কেবল দূরত্বই বাড়িয়েছে। তাই লেখক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই ধার্মিক জনগণের থেকে দূরেই থেকেছে। আবার অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের বড় বড় সাহিত্যিক হিসেবে যাদের নাম সামনের সারিতে তুলে ধরা হয়েছে তাদের উত্থানের অন্যতম প্রধান ধারাই ছিল মুসলমানদের এমন সব বিষয় নিয়ে সাহিত্যে প্রপাগান্ডা তৈরি করা যা আদতে মুসলমান সমাজ বহন করে না। অথচ মুসলমানদের ঘাড়েই তার দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন ভণ্ড পীর রাজাকার ব্যবস্থার দায় দিয়েছে দাড়ি টুপিওয়ালা কপালে সেজদার দাগ পড়া মুসল্লিদের ওপর। এভাবে বিভাজন সৃষ্টিতে সেইসব সাহিত্যিক এক বিশেষ শ্রেণীর হাততালি পেলেও দর্শক পাঠকদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে কতটা সমর্থ হয়েছেন তার প্রশ্ন থেকেই যায়। পশ্চিম বঙ্গের বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে পূজা পার্বণের উৎসব আয়োজনে সাহিত্যের ভূমিকা যত ব্যাপক। এ অঞ্চলে ঈদ উৎসবে সাহিত্যের ভুমিকা সেই তুলনায় কেবল ঈদ উপলক্ষে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধেই নিবদ্ধ। তাই পূজা সংখ্যা যে হারে জনপ্রিয় ঈদসংখ্যা, সে হারে জনসাধারণ্যে জনপ্রিয় হয় না।
বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ড মার্কস এঙ্গেলসের মতবাদ তথা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে অনেকেই বিচার করতে চেয়েছেন। অথচ মার্কস নিজেই স্বীকার করেছেন, লেখকের অন্তরদৃষ্টি (তার ভাষায়) প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে বা প্রগতিশীল হতে পারে। কারণ মার্কস লক্ষ্য করেছিলেন যে, বিখ্যাত লেখক বালজাক ক্যাথলিক ও সামন্ততান্ত্রিক দুষ্টিভঙ্গী থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ গতিবিধির ওপর তার গভীর সচেতনতা বোধ ছিল। অথচ বালজাক মার্কসের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিপরীতে অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা তার প্রতিক্রীয়াশীল লেখারও প্রশংসা করেছিলেন। মার্কস তার ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে বালজাক সমন্ধে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘বালজাকের বাস্তব অবস্থার ওপর বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল।’ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে শিল্পে বাস্তবিকতার ব্যাপারে ওই করেছিলেন, ‘বাস্তবিকতা কাচপোকার মতো আর্টে প্রবেশ করলে, তেলাপোকার মতো তাদের অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেস করিয়া ফেলে।’ অন্যত্র আরো বলেছেন, ‘ইউরোপীয় সাহিত্যে কোথাও কোথাও দেখতে পাই, মানব চরিত্রের দীনতা ও জঘন্যতাকেই বাস্তবতা বলিয়া স্থির করা হইয়াছে।’ সত্যিই কি বাস্তবতা আর্টের মধ্যে প্রবেশ করে তার অন্তরের রসকে নিঃশেস করে ফেলে? মনুষ্যত্বের ন্যূনতম মর্যাদার কথাই স্বীকার করেন বাস্তববাদীরা। বিগত এক দেড়শ বছরের বিশ্ব সাহিত্যের সেরা সাহিত্যগুলোয় বাস্তবকে আর্টের মধ্যে ফেলে বরং আর্টকেই আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে। ড্রইংরুম আর রিডিংরুমের টেবিল থেকে টেনে এনে সর্বসাধারণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। টলস্টয়ের ওয়্যার অ্যান্ড পিস, রেজারেকশন। গোর্কির মা, থিওডোর ড্রাইজারের এন আমেরিকান ট্রাজেডি, সিস্টার ক্যারী। হেমিং ওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি। বার্নার্ড শ ও ইবসেনের নাটকদয়। ও’ হ্যানরি ও মার্কেজের ছোট গল্পসহ আরও প্রচুর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রাশকিন টলস্টয় রমা রল্যার সংস্পর্ষে এসে রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেন, ‘আমি তো বলি সাহিত্যের উদ্দেশ্য সমগ্র মানুষকে মানুষ করে তোলা।’
শিল্পের সৌন্দর্য শুধু বিলাসী বিনোদনের উপকরণে নয়। এর ভেতর মানুষের প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট। আবার শুধু কল্যাণী ভূমিকায় একে বন্দী করা যায় না। আনন্দ শৈল্পিক হয়েও মানবিক হতে পারে। এ ধরনের ভাবনা বহু আগে থেকে আজ অবধি শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভাবিয়েছে এবং সে ভাবনা থেকে তাদের সৃষ্টিকেও প্রভাবিত করেছে ফলে তাদের শিল্প সাহিত্য হয়েছে কালোত্তীর্ন। আজকের দিনে জীবন যাত্রার জটিলতা যখন বেড়েই চলছে, তখন পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনায় অনেকেই বলে থাকেন সাহিত্যে পরম সত্য বলে আর কিছু নেই, সব বলা হয়ে গেছে। নতুন করে কোনো গল্প নেই। যা কিছু বলা যায় তা হলো ‘ফর্ম’ নিত্যনতুন ফর্ম এ পুরাতন গল্পই বলা। অতএব গল্প নয় ফর্ম, অথবা সবই গল্প। এক মুহূর্ত ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতির গল্প। সেটা এক লাইনেরও হতে পারে, আবার এক হাজার পৃষ্ঠারও হতে পারে। কথা যৌক্তিক। শিল্প-সাহিত্যের বিচারে ফর্ম ও কনটেন্টের দ্বন্দ নয়। শৈল্পিক সৌন্দর্য ও বাস্তবতার দ্বন্দ নয়। দ্বন্দ বোধহয় সত্য সুন্দর জীবন সংগ্রামের আশা আকাক্সক্ষার হাসি-কান্নাকে একত্রিত করতে না পারা। কল্পনায় আছে বাস্তবে নেই, এটা যেমন অনুভূতিকে নাড়া দেয়। তেমনি চোখের সামনে ঘটমান সমাজ বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই। দুটোর মিলিত রূপকে প্রবহমান করে তুলতে পারাটাই স্বার্থক সাহিত্য।


আরো সংবাদ



premium cement
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত আমদানি ব্যয় কমাতে দক্ষিণাঞ্চলের সূর্যমুখী তেলের আবাদ পাকুন্দিয়ায় গানের আসরে মারামারি, কলেজছাত্র নিহত আবারো হার পাকিস্তানের, শেষ সিরিজ জয়ের স্বপ্ন পাটকেলঘাটায় অগ্নিকাণ্ডে ৩ দোকান পুড়ে ছাই

সকল