২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রেমের কবি জীবনের কবি

-

‘কবর একদিন সব কিছু কেড়ে নেয়
কিছু মানুষের কবিতা কবরের ওপর
একটি গোলাপকুঞ্জ হয়ে গন্ধ ছড়াতেই থাকে।’
আল মাহমুদের কবরের ওপর লক্ষকোটি হৃদয়ের গোলাপকুঞ্জ ভালোবাসার সুগন্ধি দিনরাত মুখরিত করে রেখেছে। কারণ তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের কবি। মানব হৃদয়ের আর্তি, আকুতি চিরন্তন প্রেম-ভালোবাসা-সুখ দুঃখ নিয়েই দীর্ঘ জীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তার কবিতা জীবনধর্মী। পাঠক একান্তভাবে নিজেকে খুঁজে পান তার ক্ষুরধার লেখনীতে। অসহায় মানুষদের জীবনচিত্র, হৃদয়ের কামনা বাসনাÑ যা অতি সাধারণ মানুষের চোখে ধরাই পড়ে না সেই সাধারণ বিষয়গুলোকে তিনি অসাধারণ করে পাঠকদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছেন। এই সময় সব মানুষকে কাছে টেনে নেয়া সত্যিই একটি কঠিন কাজ। আল মাহমুদ কবিতার খেলায় এই কাজটি অতি সুনিপুণভাবে করেছিলেন। জীবনকে দেখেছেন অত্যন্ত কাছ থেকে। তাই তো জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে কবিতার আঙ্গিনায়, জ্বালিয়েছেন পাঠকের হৃদয়ে প্রেমের আলো।
প্রেমের কবি হিসেবে তিনি নিজেই নিজের তুলনা। একজন ধীবর বউয়ের হাঁটুর নিচের পায়ের নলার সুশ্রী বর্ণনা কী সুন্দরভাবে উঠে এসেছে তার কবিতায় তেমনি ভাস্বর অমর প্রেমকে তিনি যতেœর সাথে তুলনা করেছেনÑ নদী-আকাশ-বসন্ত-চাঁদতারা-সবুজ জমিন-নীলের সাথে। প্রেম তো স্বচ্ছ, সুন্দর-নির্মল-আনন্দময়Ñ অন্য পিঠে লেগে থাকে বিরহ-বেদনা-ব্যথা-হৃদয়ের ক্ষরণ, বেদনার জ্বলে টলমল সবুজ ঘাসের শিশির। দু’পিঠেই তিনি সফলভাবে এঁকেছেন প্রেমচিত্র। নারীর চোখের কোনার অশ্রু থেকে অতুলনীয়া খোঁপার ভেতর তিনি হারিয়েছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। সর্বত্র প্রেমের বিচরণ সাবলীল। বাস্তবতার দরোজায় তিনি দাঁড়িয়েছেন প্রেমের সবুজ শব্দগুচ্ছ নিয়ে। প্রেম ছাড়া কি এই সবুজ জমিন ফুলে ফসলে গঠিত হতে পারে? আকাশ-জমিনে প্রেমের খেলা মাঝখানে আমরা তার উপলব্ধিতে চেতনায় প্রেমকে নিয়ে আসি জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে। প্রেমের পথেই তো ঘুরছে পৃথিবী সূর্য-গ্রহ-চাঁদ। যে যার মতোন প্রেমকে নিয়েই সুখী হতে চাইছে। প্রেম ছাড়া সুখী হওয়া আদৌ যায় না। প্রভুপ্রেম থেকে গাছপালা-লতাপাতা-বাহারি ফুল-রঙিন পাখির বর্ণিল কণ্ঠের মধুর গানেÑ সবখানেই তো প্রেমের খেলা। সেই প্রেমকে তিনি দেখেছিলেন তার ভেতরের চোখ দিয়ে নিবিড়ভাবে। চোখের দর্পণখানা ছিল অতি নিখুঁত। সেজন্যই নারী হৃদয়কে তিনি এঁকেছেন একান্ত নিজস্বভাবে, নিজস্ব জাতিতে, নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিন্দু বিন্দু ঘামেও প্রেমেরা মুক্ত হয়ে ঝরেছে।
প্রত্যেক কবিরই একটি নিজস্ব বলয়, একটি আঙিনা থাকে। থাকে নিজস্ব খোলা আকাশ। খোলা আকাশের নিচে তো বটেই, আকাশের চূড়ায় রেখে তিনি নারীকে এঁকেছেন প্রেমিকা-প্রেরণাদাত্রী-স্নেহময়ী মা-বোনÑ সবক্ষেত্রে পূর্ণ দক্ষতার বেহালা বাজিয়ে। জীবনের সব বালুচরে নারী আছে জীবনের বাঁশি হাতে। নারী শুধু নারী নয়Ñ নারী ছাড়া কি জীবন হয়। তার অসংখ্য লেখায় তিনি রেখেছেন নারীকে কাছাকাছি, বাস্তবতার মতোন। এ জন্য তিনি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এসে করেছেন জগতের সবচেয়ে সুনিপুণ সুচারু বর্ণিল কারুকাজ। যার নাম কবিতা। জীবনের জটিল পর্বগুলোকে কি সাবলীলভাবে পার করেছেন সাধারণ বর্ণনায়, যা এতটুকুও প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। সব মানুষই যেসব কাজে নিত্য অভ্যস্ত সেখানে তার এই বিজয়ী পদচারণাই তাকে অমর করে রেখেছে। পাঠক তাকে ভুলবেন কিভাবে। পাঠকের হৃদয়ে গভীরতম গহিনে এই প্রেম যে নিত্যজাগরুক হয়ে আছেÑ চঞ্চল করে তোলে প্রেম বালুচরে। কবিতাগুলো শুধু কবিতাই নয়Ñ হৃদয়ের লিপিতে লেখাগুলো খোদাই হয়ে গেছে, যা কিনা প্রতিটি কাজে কর্মে স্মরণে ভাসে। এখানে তিনি যারপরনাই সফল। প্রেম সত্য সুন্দর অনিবার্যÑ একে অস্বীকার করা যায় না। তাইতো তিনি বহুলভাবে পঠিত নন্দিত-পাঠকের হৃদয়ে মুদ্রিত। কখনো বা উচ্ছলতা কখনো ব্যথাতুর কখনো চঞ্চল-কখনোবা চোখের কোণের জল হয়েই পাঠকের কাছাকাছি তিনি।
আবার বিদ্রোহের বারুদ জ্বেলেছিলেন। কবিতার আনন্দে তিনি পাঠকের কাছে বাঙময় হয়ে আছেন। সহজ সরলতার আদলে তিনি জাগতিক কাজগুলোকে তুলে এনে পাঠকের হৃদয়পুরে তুলে দিয়েছেন। পাঠক তাকে ছাড়া চলবেন কিভাবে? তার এই অসীম শূন্যতা কি আদৌ পূর্ণ হবে। বাতায়নের খোলা বাতাসেরা বয়ে বেড়ায় তার সোনালী কাবিন। কী অসাধারণ সৃষ্টি। সোনালী কাবিনের এই কবি আকাশ-নদী তরুলতা-সাগর-পাহাড়-ঝর্ণা-প্রেম-কোথায় নেই? এক জীবনে এত সৃষ্টি সম্ভব? একটি নদী তার কাছে একটি জীবনÑ একজন প্রেমিকাÑ একটি ভাঙন, একটি প্রতিবাদ, একটি আশ্রয়, একটি চেতনা, একটি ভরসা। আরো কত কি দেখেছেন একটি নদীর জ্বলের শুভ্রতায় ঢেউয়ে। একটি নদী তার কাছে দীর্ঘ প্রেমের পথ। একটি ফুল শুধু ফুলই নয় দেখেছেন অন্তরের চোখ দিয়ে। থেকেছেন দীপ্ত হয়ে ঘাসের সবুজে আকাশের নীলে মেঘের জটিলতায়। সবকালেই তার বিচরণ থাকবে অসম্ভব আকর্ষণের বলয়ে। অমরত্ব তিনি আগেই পেয়েছেন। কি অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম তার। খোদা তার হৃদয়ে কি মূল্যবান প্রেম ও সৃষ্টি ক্ষমতা দান করেছিলেন। জীবনে তিনি অনেক পেয়েছেন। পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত ষোলোআনা। তার পরেও বঞ্চিত হয়েছেন পদে পদে। মূল্যায়ন হয়নি তার প্রতিভার। একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। বেদন তার না থাকলেও আমাদের আছে। আনন্দ অশ্রুর সাথে মিশে যায় না পাওয়ার বেদনায় জলগুলো। বঞ্চনার দীর্ঘ সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন সুনিপুণভাবে। আল মাহমুদের কলম ছিল বখতিয়ারের ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামীÑ সাত আসমানে তার কলমের ছোঁয়া হয়তো পৌঁছেছে। আল্লাহর আরশে তার কামনা ইচ্ছেগুলো হয়তো কবুল হয়েছে। মহাকালের যোজন যোজন সময়ের সুরের সাথে সাথে বাজবে তার কবিতার বাঁশি। যত দিন থাকবে নীল আকাশ, খোলা বাতায়নÑ তার কবিতার সুর ওখানে ততদিনই ভাসবে ইথারে। উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে লক্ষকোটি পাঠকের হৃদয়ের অলিগলিতে তিনি বহুকাল থেকেই দিনযাপন করেছেন। আমরা তাকে স্মরণ করছি। কারণ মৃত্যু মানেই শেষ নয় বরং মহাকালের মহাযাত্রার একটি দুয়ার মাত্র। সেই যাত্রায়ও তার জন্য অসংখ্য শুভকামনা। যেখানেই থাকবেন তিনি ভালোই থাকবেন। শতকোটি লাল গোলাপ হৃদয়ের রক্তিম ভালোবাসা তার জন্যই চিরকাল। শুধু তারই জন্য। হে কবি, তুমি শান্তিতে ঘুমাও। দীর্ঘ জীবন তুমি কলম রেখেছিলে হাতে। শান্তিতে ঘুমাতে পারোনি।
“হে বারুদগন্ধি মানচিত্র, বন্ধ করো তামাশা
বন্ধ হোক ঝরে পড়া, মরে যাওয়ার ক্রন্দন,
এই অন্ধ চোখ দুটি হয়ে থাক হেমন্তের খুব ভোর বেলা-
... খুলে ফেলো মৃত্যুর মেখলা।” হ


আরো সংবাদ



premium cement