২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবদুর রশীদ খান

-

১৯৫০-এর দশকে কাব্যক্ষেত্রে সাড়া জাগানো এক কবির আত্মপ্রকাশ। বহুল আলোচিত বাংলাদেশের প্রথম কাব্য সঙ্কলন ‘নতুন কবিতা’র অন্যতম সম্পাদক কবি আবদুর রশীদ খান (ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন) কবিতার ভুবনে এক সময় প্রাণের উষ্ণতা ছড়িয়ে মানুষের অনুভূতির জগতে নাড়া জাগাতেন। তিনি শব্দ গন্ধময় পৃথিবী থেকে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। আমেরিকায় প্রবাস-জীবন যাপন করতেন।
যুগ-বিবর্তনের সহজাত যন্ত্রণা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবতার চরম লাঞ্ছনার বিপরীতে এক অনিবার্য প্রতিবাদী কণ্ঠ আবদুর রশীদ খান ১ জানুয়ারি ১৯২৪ সালে বর্তমান চাঁদপুর জেলার, চাঁদপুর শহরের পার্শ¦বর্তী পশ্চিম জাফরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী ওয়াইজউদ্দীন খান, মাতা-কাদ্রুন নেসা। রঘুনাথপুর প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি গৃদকালিন্দিয়া এমই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, জামুর্কী নবাব স্যার আবদুল গণি হাইস্কুল, ঢাকা ইন্টার কলেজ ও সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে ইংরাজিতে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে আবদুর রশীদ খান প্রথমে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে ১৯৫১-৫২ পর্যন্ত এবং ঢাকা গভ. কলেজে ১৯৫২-৫৫ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি ১৯৫৫-৭৫ পর্যন্ত সরকারের বাংলা অনুবাদক ও প্রকাশনা রেজিস্ট্রার হিসেবে এবং ১৯৭৫-৮৩ পর্যন্ত পরিচালক, অনুবাদ ও প্রকাশনা নিবন্ধন পরিদফতরে চাকরি করেন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় স্কুল ম্যাগাজিনে আবদুর রশীদ খানের গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ম্যাগাজিনে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। এরপর ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৫২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীসহ তিনি যৌথভাবে ‘নতুন কবিতা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৫৯ সালে তার সম্পাদনায় ‘প্রেমের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত রচনাবলীর তালিকা এরূপ :
কবিতা গ্রন্থ : নক্ষত্র : মানুষ : মন ১৯৫২, বন্দী মুহূর্ত ১৯৫৯, মহুয়া ১৯৬৫, বিম্বিত প্রহর ১৯৬৮, অন্বিষ্ট স্বদেশ ১৯৭০, সমস্ত প্রশংসা তাঁর ১৯৮০ ও ১৯৮৬, তিমির হনন ১৯৮৮, অলৌকিক এক দীপ ১৯৯১, নির্বাচিত কবিতা ২০০৬।
কবিতা সঙ্কলন সম্পাদনা : নতুন কবিতা ১৯৫০, প্রেমের কবিতা ১৯৫৯।
অনুবাদ : আকাশ জয়ের ইতিকথা ১৯৬০, মুক্তা ১৯৬২, কিশোর মনীষী ১৯৬৭, ইকবালের যবূর-ই-আজম কাব্যানুবাদ ১৯৮৭, ঝড়সব ঝবষবপঃবফ চড়বসং ড়ভ ঋধৎৎঁশয অযসধফ ২০০৮
কিশোর কাব্য : আল-আমীন ১৯৯১
অপ্রকাশিত রচনাবলি : ফুল হবো, না পাখি হবো, অদৃশ্য বন্দর খুঁজি কাব্যগ্রন্থ, শুরু নেই শেষ নেই (কাব্যগ্রন্থ), দুরন্ত কৈশোর (স্মৃতি কথা), হাকল্ বেরী ফিন (ভাবানুবাদ), টম সয়ার (ভাবানুবাদ), টম কাকার কুটির (ভাবানুবাদ), ভালো লাগার প্রতিধ্বনি (বিদেশী কবিতার অনুবাদ), কিশোর কবিতা, গানের বাণী ও হারানো দিন (কিশোর কবিতা)।
উপরোক্ত তালিকা থেকে দেখা যায়, কবির প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭টি। এর মধ্যে মৌলিক রচনা, অনূদিত কবিতা ও ভাবানুবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর রচনা রয়েছে। কবিতার মধ্যে আবার রয়েছে বেশ কিছুসংখ্যক সনেট। গীতি কবিতা ও সনেট উভয় শ্রেণীর রচনাতেই কবি বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তার কবিতা রচনার পটভূমি দেশ ও বিদেশ অর্থাৎ শেষ জীবনে তিনি ২০০৩-এর ১২ মার্চ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় বসবাস করেছেন। বিদেশে নিরবচ্ছিন্ন অবসর জীবনে তিনি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। স্বদেশে অবস্থানকালে তার লেখার ভাব-বিষয় ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই যেমন তার স্বদেশ-ভাবনার পরিচয় অধিক পাওয়া যায়, তেমনি বিদেশে অবস্থানকালে তার লেখালেখির মধ্যেও সেখানকার অনেক কিছুর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক। কবি বা লেখক দেশ-কালের প্রতিনিধিত্ব করেন। যখন যে দেশে বা যে সময়ে তারা অবস্থান করেন, তখন সে দেশ ও সময়ের প্রভাব তাদের লেখার মধ্যে ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বিদেশে অবস্থানকালে দেখা যায়, কবি তার নিজের কবিতা বিদেশীদের কাছে পরিচয় করানোর জন্য ইংরেজিতে তা অনুবাদ করেছেন। অনুরূপভাবে প্রখ্যাত বিভিন্ন ইংরেজ কবির কবিতা তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে স্বদেশবাসীর কাছে তা পরিচিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই তার দখল থাকাতে তার পক্ষে এটা সহজ হয়েছে। এখানে কবি আবদুর রশীদ খানের ‘রেল-লাইন’ শীর্ষক একটি বিখ্যাত কবিতা উদ্ধৃত হলো :

রেল লাইন
এই রেল-লাইনের পাশে
তুমি-আমি আজ মুখোমুখি।

চারিদিকে জল আর জল,
সবুজ ধানের গাছে উতলা বাতাস
কী যে কয়ে যায়
কিছু বুঝি,
কিছু তা’র বাতাসেই হয়ে যায় লয়।
এই রেল-লাইনের পাশে
তুমি আর আমি,
কতো গাড়ি যায় আর আসে,
আসে আর যায়,
জল ছুঁয়ে চাঁদ ডুবে যায়,
জল তবু পেয়েছে কি চাঁদের পরশ।
তবু দেখি চাঁদ এসে জল ছুঁয়ে যায়;
রেল-লাইন চলে গেছে দূরে,
বহুদূরে-আরো দূরে,
দুইটি লাইনে জানি সব-ব্যবধান,
কোনোখানে মিলে নাই তা’রা
তবু যেন মনে হয় দিগন্তের কোণে
তা’রা মিশে গেছে,
এক হ’য়ে গেছে।
তুমি-আমি আজো কাছে কাছে-
এই দেখো : তুমি তো আমার হাতে
তোমার কোমল হাত
আলগোছে রেখেছো এখন,
তবু জানি :
আমাদের ব্যবধান হাজারো যোজন;
গাড়ি যায়, গাড়ি আসে,
রেল-লাইন সমান্তরাল,
কা’রো চোখে মিশে গেছি,
তবু, মিশি নাই,
তবু কাছাকাছি
এই রেল-লাইনের মতো।
(নক্ষত্র মানুষ মন : মার্চ ১৯৫২)

 


আরো সংবাদ



premium cement