২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বইমেলা এবং বাংলা ভাষা

-

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সারা দেশে একটা হইচই পড়ে যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষভাবে ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্র প্রচার করে এবং ভাষাসৈনিকদের সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কার্যক্রম হাতে নেন। প্রিন্ট মিডিয়া ভাষা দিবস তথা শহীদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যার আয়োজন করে। নামীদামি লেখক-কবিদের স্মৃতিবিজড়িত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধন ছাপে। লেখক ও কবি এবং প্রকাশকরা বই লেখা ও ছাপার কাজে মহাব্যস্ত থাকেন। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বসে একুশের বইমেলা। যেটা এ দেশের লেখক ও প্রকাশকদের প্রাণের মেলা। সারা দেশের বইপ্রেমীরাও ছুটে আসে বইমেলায়। পছন্দনীয় লেখকের দু’একটা বই কিনে নেয়ার প্রত্যাশায়। প্রিয় লেখকের সাক্ষাৎ পেলে স্মৃতির পাতায় রেখে দেয়ার জন্য অটোগ্রাফ নেয়। দিনব্যাপী মেলা প্রাঙ্গণে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, গল্পকার, নাট্যকারের আলোচনা সভা ও আড্ডায় মুখরিত থাকে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য গুণী ব্যক্তিদের একুশে পদক দিয়ে কর্মের স্বীকৃতি দেয়া হয়। সব মিলিয়ে বাঙালি তথা বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তাদের জীবনে এবং তাদের শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে একুশ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একুশে ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে।
ক্রমান্বয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি তথা শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপলাভ করেছে। সারা বিশ্বের মানুষ ভাষা দিবস হিসেবে এই দিনটিকে পালন করে। সর্বসাফল্য বোঝা যায়Ñ এই দিনটি স্মরণীয় একটি দিন। কোনো একটি দিন এমনি এমনি তাৎপর্যপূর্ণ হয় না এবং কেউ ইচ্ছা করলে একটি দিনকে একটি দিবসে রূপান্তর করতে পারে না। এর পেছনে থাকে সমষ্টিগত কিছু ত্যাগ এবং সমষ্টিগত প্রচেষ্টা। একুশ তথা একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনে মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
আমার মায়ের ভাষা তথা বাঙালি জাতির প্রাণের ভাষা বাংলা। এই ভাষার জন্ম প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হলেও তা রাষ্ট্রীয় ভাষায় মর্যাদা লাভ করে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে, বাঙালির রক্তে রাজপথের কালো পিচঢালা রাস্তাকে লালে-লাল করে। কিছু সংগ্রামী তরুণের আত্মবলীদানের বিনিময়ে এই ভাষা মায়ের আসনে অতিষ্ঠিত হয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যেÑ ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। একমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্য আন্দোলন করে বিশ্বের বুকে অদ্বিতীয় একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। আজ বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অপরাপর দেশেও শ্রদ্ধার সাথে এই দিবসটি উদযাপন করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণীর সব জাতির মানুষ মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা করে এবং মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এই দিনটিকে পালন করে থাকে। মা এবং মাতৃভাষা প্রতিটি মানব সন্তানের হৃদয়ের গহিনে লালিত-পালিত হয় মরণ অবধি। তাই মায়ের ভাষা তথা মায়ের মুখের বুলিকে রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেনি বাঙালিরা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। মায়ের মুখের বুলিকে রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ঘটনা আর একটিও নেই। কোনো ধনসম্পদ রক্ষার্থে কিংবা দেশ রক্ষার্থে নয়, শুধু মায়ের ভাষাকে আগলিয়ে ধরে রাখতে রক্ত ঝরানো ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি। ভুলে যাচ্ছি ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল, কী জন্য এতগুলো মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিলো। ভুলে যাচ্ছি এই দিবসের মূল মন্ত্র কী ছিল, এর তাৎপর্য ও গুরুত্বই বা কতটুকু। আমরা আজ স্বার্থসিদ্ধির অন্বেষণের পেছনে ধাবিত হচ্ছি। বাংলা ভাষা ও আমাদের সংস্কৃতিকে পদতলে পিষে অপসংস্কৃতিকে গলার মালা হিসেবে ধারণ করছি এবং ভিনদেশী ভাষা চর্চায় মত্ত হয়ে গেছি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে। চলনে বলনে আমরা ভিনদেশীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করছি। ফলে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা চর্চার হিড়িক পড়েছে। হিন্দি গান ও ছবি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দিন দিন বাংলাদেশী তথা বাঙালিদের গ্রাস করে ফেলছে। হিন্দি ছবি ছাড়া এবং হিন্দি গান ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। আর ইংরেজির কথা বলে তো লাভ নেই। দুই-চার ছত্র ইংরেজি কেউ বলতে পারলে তার সাথে লাগে কে। ইংরেজি যে বলতে পারে সে তো আর মাটিতে থাকে না, আকাশে ওড়ে। তাই বলে আমি হিন্দি ভাষা এবং ইংরেজি ভাষা চর্চার বিরোধী নই। তবে যথাযথ জায়গায় যথাযথ ভাষা ব্যবহার করার কথা বলছি। চলতে ফিরতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় সাধারণ মানুষের সাথে কিছু কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি ইংরেজিতে কথা বলে অথচ যাদের সাথে বলে তারা কিছুই বোঝে না। আমার কথা হলো, যেখানে ইংরেজি ভাষা বলা প্রয়োজন তাদের সাথে ইংরেজি বলো এবং যেখানে হিন্দি বলা প্রয়োজন সেখানে হিন্দি বলো, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, দেমাগ দেখানোর জন্য, তাকাব্বরি করার জন্য ভিনদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির লালন-পালন করা হয় এবং তার চর্চা করা হয়; তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত। এভাবে প্রতিদিন আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতির গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করছে। আধুনিকতার নামে আমরা আজ আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হারাতে বসছি। এই ভাষা আমার অস্থিত্ব; এর সাথে আমার আত্মার বন্ধন রয়েছে। কিভাবে আমরা প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অঙ্গগুলোকে কেটে ফেলছি। নব্যতার নামে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপকরণগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছি।
কবি আল মাহমুদ বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা ও জাতীয় বিপ্লবের বীজমন্ত্র’। মূলত ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিজেদের অধিকার আদায় করার উৎসাহ উদ্দীপনা লাভ করেছে। ফলে ১৭৯১ সালে সব অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। যে চেতনায় আমাদের পূর্ববর্তীরা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, আজ আমরা সেই চেতনা শক্তি হারিয়ে অসহায় হয়ে আছি। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম জানে না যে, ভাষা আন্দোলনটা কী ছিল? তারা জানে ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ভাষার জন্য হয়েছিল। এটা যে মূলত অধিকার আদায়ের আন্দোলন, নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন তা আজ অবদি কারো মগজে ধরেনি। তাই অচেতন হয়ে আছি। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ শহীদ মিনারে ফুল দিলাম আর গান গাইলাম-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। এই সুর কণ্ঠ থেকে বের হওয়ার পর আর জায়গায় স্থির থাকে না, হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। তাই আমরা আজ স্তিমিত হয়ে পড়েছি। আমাদের চেতনা শক্তি নেই, হক কথা বলার মতো সাহস ও মনোবল নেই। আবার ফিরে যেতে হয় কবি আল মাহমুদের কথায়Ñ ‘ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা ও জাতীয় বিপ্লবের বীজমন্ত্র’। এই বীজকে অঙ্কুরিত করতে হবে। জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের সব অধিকার আদায়ের পদক্ষেপ নিতে হবে। শেষ কথায় বলা যায় যে, ফেব্রুয়ারি মানুষকে অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা জোগায়, উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে। এই দিনে শপথ নিতে হবেÑ ভিনদেশী ভাষা এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি পরিত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের ‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

সকল