সংবাদমাধ্যমে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ যত খবরাখবর প্রচারিত হচ্ছে, তার একটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে। ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যিনি কংগ্রেসে ইমপিচমেন্টের শিকার হলেন। হাউজ তার বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় দিয়েছে। একটি অভিযোগ তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। আরেকটি হচ্ছে তিনি কংগ্রেসের কার্যক্রমে বাধ সেধেছেন।
দু’টি অভিযোগের ক্ষেত্রেই ইমপিচমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট পড়েছে প্রতিনিধি পরিষদে। প্রথম অভিযোগের ক্ষেত্রে ২৩০ ভোট পড়েছে ইমপিচমেন্টের পক্ষে এবং ১৯৭ ভোট পড়েছে বিপক্ষে। দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ২১৬ ভোটের বেশিসংখ্যক ভোট পড়েছে। ওই অভিযোগে ইমপিচমেন্টের পক্ষে পড়েছে ২২৯ ভোট ও বিপক্ষে ১৯৮ ভোট।
এই ভোটাভুটি যখন চলছিল তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি প্রচারণা সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। পরে হোয়াইট হাউজ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে, সিনেট ট্রায়ালে অভিযোগ থেকে ‘পুরোপুরি অব্যাহতি পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত’ প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছাড়া আর যে দু’জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আগে ইমপিচমেন্ট হয়েছে তারা হলেন অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ইমপিচমেন্টের শিকার হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন তার প্রেসিডেন্ট থাকতে পারা না পারা নির্ভর করছে সিনেটের শুনানিতে।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ইমপিচমেন্টের শিকার হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। মিথ্যা কথা বলে শপথ ভঙ্গ করা এবং বিচারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে তাকে ইমপিচমেন্ট করা হয়েছিল। হোয়াইট হাউজেরই একজন ইন্টার্ন মনিকা লিউনস্কির সাথে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে মিথ্যা বলেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এ বিষয়ে তিনি মনিকা লিউনস্কিকেও মিথ্যা বলতে বলেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু পরে ১৯৯৯ সালে যখন এসব অভিযোগে উচ্চকক্ষ সিনেটে বিল ক্লিনটনের বিচার হয়, তখন তাকে আর দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি। কারণ এসব অভিযোগের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থন পাওয়া যায়নি। ফলে বিল ক্লিনটনকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়নি। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম ইমপিচমেন্টের শিকার হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট নেতা প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন। ১৮৬৮ সালে কংগ্রেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি সেক্রেটারি অব ওয়্যার বা যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এডউইন স্ট্যানটনকে বরখাস্ত করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারে বাধা দেয়ার। সেবার তাকেও ক্ষমতা হারাতে হয়নি। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। একটিমাত্র ভোটের অভাবে তার ইমপিচমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পাওয়া যায়নি।
অনেকে বলে থাকেন যে অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জনসন কেঁদেছিলেন এবং বলেছিলেন যে নিজের মর্যাদা উদ্ধার করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করবেন। এর পরে যতটুকু সময় তিনি ক্ষমতায় ছিলেন তার পক্ষে দেশ চালানো খুব একটা সহজ ছিল না। ১৮৬৯ সালে ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের কাছে পরাজিত হলে হোয়াইট হাউজ থেকে তিনি বিদায় নেন। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন ছিলেন এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কখনো স্কুলে যাননি তিনি।
আরো একজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তিনি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ১৯৭২ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অফিসে তার দল আড়ি পেতেছিল। তদন্তে দেখা যায়, দু’জন অফিসের ভেতরে গোপনে যন্ত্র বসিয়েছিল, তাদের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রচারণা তহবিল থেকে অর্থ দেয়া হয়েছিল। পরের দুই বছর ধরে তিনি ওই কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাকে ইমপিচমেন্টের জন্য ভোটের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই ভোট আর হয়নি, কারণ তার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। তার ইমপিচ হওয়া মোটামুটি নিশ্চিত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের ঘটনা বিরল। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, যেখানে আইন তৈরি করা হয়, তারা দেশটির প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, বেশ কিছু অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্টকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া অর্থাৎ তাকে ইমপিচ করা যেতে পারে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেয়া অথবা অন্য কোনো বড় ধরনের কিংবা লঘু অপরাধ।
ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে। এটি মার্কিন কংগ্রেসের একটি অংশ। এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটি সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতে হবে। আর সেটা পাস হলে পরের ধাপে বিচার অনুষ্ঠিত হবে সিনেটে, যেটা কংগ্রেসের দ্বিতীয় অংশ। এটা অনেকটা আদালত কক্ষের মতো, যেখানে সিনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে কাজ করবেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট দোষী কি নির্দোষ। প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিতে হবে।
কিন্তু রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেটে এই ইমপিচমেন্ট ধোপে টিকবে না বলেই ধারণা। ফলে প্রেসিডেন্ট পদও হয়তো হারাতে হবে না ট্রাম্পকে।
তবে যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন আসছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বছরের শেষের দিকে। ওই নির্বাচনের ফলাফল হয়তো বর্তমানের এই হিসাব-নিকাশকে বদলে দিতে পারে। হ