২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কিশোরগঞ্জে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার

শহরে সক্রিয় ১০-১১টি; প্রতিটিতে সদস্য ৫০-৭০ জন
-

কিশোরগঞ্জে দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে উঠতি কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগেই শহরের কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক সময় বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ইভটিজিং, নিজেদের মধ্যে মারধরে তারা সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় এবং যুবলীগের কিছু বড় ভাইদের আশীর্বাদপুষ্ট এই কিশোর গ্যাং সদস্যরা এখন চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ এবং খুনখারাবির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক ঘটনাও ঘটিয়ে যাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ শহরে বিভিন্ন নামে ডজনখানেক ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয় রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শহরের বিভিন্ন কর্নারে কিশোর অপরাধীদের ১০ থেকে ১১টি গ্যাং আছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ৫০ থেকে ৭০ জন করে সদস্য রয়েছে। এসব গ্যাং কালচারের কিশোরদের বেশির ভাগই মাদকসেবী।
এরা শহরের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের কেউ কেউ স্কুলে পড়ালেখা করলেও অনেকেই ঝরে পড়া ছাত্র। বখে যাওয়া এই কিশোরদের অভিভাবকেরা শহরের প্রভাবশালী ও পরিচিত মুখ। তাদের কারো কারো বাবা ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িত। ফলে অপরাধ করলেও কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। আইনের আশ্রয় নিতেও ভয় পান। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসব কিশোর ধরা পড়লেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
গত বৃহস্পতিবার শহরের বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে এমনি একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ১১ সদস্যকে আটক করে র্যাব। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে র্যাব-১৪ সিপিসি-২, কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের সদস্যরা অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে বত্রিশ বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন তাতিপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। আটককৃত ১১ জনের ছবিসহ র্যাব প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পাঠায় জেলার সংবাদকর্মীদের কাছে। ১১ সদস্যের মধ্যে এ গ্রুপের অন্যতম প্রধান হিসেবে আটক ছিল শহরের খরমপট্টি এলাকার বাসিন্দা সমির কুমার বৈষ্ণবের ছেলে সৌমিত্র বৈষ্ণব। সমির কুমার বৈষ্ণব মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় চাপের মুখে পুলিশ তার ছেলে সৌমিত্র বৈষ্ণবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
২০১৮ সালের প্রথম দিকে প্রথমে সঙ্ঘবদ্ধভাবে রাস্তায় নামে ওই সব দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং। এর আগে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যলয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ইভটিজিং, এলাকায় এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে ছোটখাটো মারামারির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তারা। রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে এক সময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে এই কিশোর গ্যাং। ব্যবহার হতে থাকে ছাত্রলীগ যুবলীগের হাতিয়ার হিসেবে। ঠুনকো বিষয় নিয়ে এই কিশোর সন্ত্রাসীরা হকি স্টিক, চাপাতি, রাম দা, ছুরি-লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামা শুরু করে। বাসাবাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর করার পাশাপাশি তারা পথচারীদেরও কুপিয়ে জখম করে।
২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল শহরের কিশোর গ্যাং লিডার নিলয়ের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে বড়বাজার এলাকায় রাজা নামের এক কলেজ ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শহরের ঈদগাহ রোড (রেল ক্রসিং) থেকে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র নিলয়কে গ্রেফতার করা হয় এ ঘটনায়। তাকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে ভয়ঙ্কর ও চাঞ্চল্যকর তথ্য। নীলগঞ্জ মোড়ের মো: কাজল মিয়ার ছেলে নিলয় পুলিশকে ওই সময় জানায়, তার গ্যাংয়ে সমবয়সী শতাধিক কিশোর আছে। তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ হামলার সময় মানুষ ভয় পেলে তাদের আনন্দ বেড়ে যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তারা ভয়ঙ্কর অ্যাকশনে যায়। কখনো গ্যাংয়ের কোনো সদস্যের সাথে কারো ঝগড়াঝাটি হলেও সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্রতিপক্ষের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা।
রাজা হত্যার সিসি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ দেখেছেÑ বড়বাজার তেড়িপট্টি মোড়ে কলেজছাত্র রাজাকে মুখোশ পরা ১৬ থেকে ১৭ জন কিশোর আনন্দের সাথে কোপাচ্ছে।
ওই সময় একাধিক অভিযান পরিচালনা করে নিলয়ের সহযোগী সানি, পিয়াস, সোহাগসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল তুচ্ছ ঘটনার জেরে জজকোর্টসংলগ্ন পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথে সাগর নামের এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ব্যবসায়ী সাগর হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর মডেল থানায় ওসি (তদন্ত) মো: মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এ হত্যা মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২১ জনই কিশোর। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর।
২০১৯ সালের ১৭ জুলাই জেনারেল হাসপাতালের সামনে থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য জসিম উদ্দিনকে হাত-পা বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পরে সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের নীলগঞ্জ এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে তাকে আটকে রাখে। এরপর তার কাছ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা ও মোবাইল সেট কেড়ে নেয় এবং মারধর করে মুক্তিপণ দাবি করে। বিকাশ নম্বরে ২০ হাজার টাকা পাঠানোর পর জসিম মেম্বারকে মুক্তি দেয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) যে কিশোর গ্যাংয়ের ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় তাদের কাছ থেকে র্যাব একটি চিঠি উদ্ধার করে। এই চিঠি দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠে যায় র্যাব সদস্যদের। চিঠিতে শহরের বত্রিশ এলাকার তিনটি বাসায় সশস্ত্র আক্রমণ করার পরিকল্পনা লেখা ছিল। উগ্রবাদী গ্রুপগুলো যেভাবে আক্রমণের আগে সদস্যদের প্রতি নির্দেশনা দেয় ঠিক সেভাবেই চিঠিতে আক্রমণের নির্দেশনা ছিল।
জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা শহরের কিশোর গ্যাংগুলোকে ধরার চেষ্টা করছি। অনেককে আমরা গ্রেফতারও করেছি, কিন্তু রাজনৈতিক চাপে অনেক সময় আমরা সফল হতে পারছি না।’

 


আরো সংবাদ



premium cement