২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে এসে আরো অসুস্থ হচ্ছে রোগী

দেয়াল ভাঙার বিকট শব্দে বাড়ছে রোগীর যন্ত্রণা ; ধুলাবালুতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
-

১৫ বছরের কন্যাসন্তান দোলনের প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ৯ দিন আগে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩ শ’ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করান বন্দর আমিন আবাসিক এলাকার আশরাফ হোসেন গাজী। ভর্তির পর থেকে দোলন আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, যেখানে দোলন ভর্তি আছে তার বেডের দুই হাত দূরেই হাসপাতালের সংস্কার কাজ চলেছে। বড় বড় হাতুড়ি-হ্যামার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে দেয়াল। সেখান থেকে বিকট শব্দে বেড়ে যাচ্ছে রোগীর যন্ত্রণা। এ সময় বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে থাকে রোগীরা। পাশাপাশি পুরো ওয়ার্ড ধুলাময় হয়ে পড়েছে। এক দিকে রোগীর চিকিৎসা, অন্য দিকে দেয়াল ভাঙার কাজ চলায় অসুস্থ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে।
ওয়ার্ডের বাইরে এসে বুধবার দুপুরে আশরাফ গাজী নয়া দিগন্তকে জানান, মেয়েকে এলাম চিকিৎসা করাতে এখানে এসে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের সংস্কার কাজ চলছে। তাই হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ভাঙার শব্দে সুস্থ মানুষও টিকে থাকা দায়। রোগীর সেবার পরিবর্তে যন্ত্রণা আর দুর্ভোগ আরো বাড়ছে।
দোলন যেখানে ভর্তি তার পাশের বেডে কাপড় মুড়ে দিয়ে শুয়ে আছে নাক, কান, গলার চিকিৎসা নিতে আসা ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধা মিনার বেগম। তার পুত্রবধূ জানান, তার শাশুড়ি এখানে ভর্তির পর আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দেয়াল ভাঙার বিকট শব্দে তিনি এখন বেশি অসুস্থ।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে কৃত্রিম যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন ওয়ার্ডের রোগীরা। ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি রেখেই দেয়াল ভাঙার কাজ চলছে। এ কাজে বড় বড় হাতুড়ি-হ্যামার ব্যবহার হচ্ছে। এতে প্রচণ্ড শব্দে কান জ্বালাপালা রোগীদের। একই সাথে পুরো হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ধুলাময় হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়ই রোগীরা খাবার-দাবার সারেন এবং কানে বালিশ চাপা দিয়ে অসহায়ের মতো বিছানায় শুয়ে দিন পার করেন রোগীরা।
হাসপাতালের অনেক কর্মচারী বলেন, এটিকে হাসপাতাল বললে ভুল হবে। ময়লা আবর্জনা ভরে গেছে। চিকিৎসাসেবা নিতে এসে রোগী যন্ত্রণা পোহাচ্ছেন।
সরেজমিন দেখে গেছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্রতিটি ওয়ার্ডের পাশে রাখা হয়েছে সিমেন্টে বোঝাই বস্তাসহ অন্যন্য মালামাল। সেগুলো থেকে ধুলা উড়ছে। প্রসূতি ওয়ার্ডে দেখা গেছে বাইরে চলছে দেয়াল ঘষার কাজ। সেখান থেকে ধুলাবালি পুরো ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্ডে। এতে করে ছড়িয়ে পড়ছে রোগ জীবাণু।
দিনে এসব কাজ চলছে তাতে রোগীদের সমস্যা হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে রাজমিন্ত্রির হেলপার রাজু জানান, কাজ তো করতে হবে। ধুলাবালি উড়লে আমাদের তো করার কিছু নেই। টাইলস বসালে ধুলা বের হবেই।
হাসপাতলে রোগীর সাথে আসা তাহমীদ ক্ষোভের সাথে জানান, এটা কোনো হাসপাতাল হইলো? এই অবস্থায় সুস্থ মানুষও খারাপ হইয়্যা যাইবো। ধুম ধুম আওয়াজ কানে আইতেই থাকে। কতক্ষণ টেকা যায় কন? রোগীরা কানে বালিশ চাইপ্যা শুইয়্যা থাকে। কেউ কেউ দিনের বেলা বাইরে থাকে। তিনি বলেন, কাম বন্ধ হইলে বিছানায় আহে। হাসপাতালের ঢোকার সময় বড় গেটে একটা বোর্ডে লেখা দেখলাম, হর্ন বাজানো নিষেধ। আর ভেতরে আইহ্যা দেহি হরনের বাপ। এর কি কোনো বিহিত নাই?’ ডাক্তারদের কাজের সময় এমন ভাঙানোর কাম কি করতে পারব?
এটিকে হাসপাতাল বলা যায়? জানা গেছে, হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার উত্তর পাশে মোট তিনটি ওয়ার্ড। এটি মেডিসিন, সার্জিক্যাল, ইএনটি, অর্থোপেডিক রোগীদের জন্য। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রায় ৭০ জন রোগী ভর্তি করা যায়। এটি অপারেশনযোগ্য রোগীদের ওয়ার্ড। তবে কিছু দিন আগে শুরু হয়েছে এই ওয়ার্ডের পূর্ব দিকের দেয়াল ভাঙার কাজ। যা এখনো চলছে। এক দিকে শয্যাশায়ী রোগী, আরেক দিকে দেয়ালে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের প্রচণ্ড শব্দের কারণে সুস্থ কোনো ব্যক্তিরই মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা দায়। তার ওপর ভাঙা দেয়ালের ধুলার কারণে ওয়ার্ড ছাড়াও পুরো হাসপাতালের পরিবেশ হয়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের একজন নার্স জানান, ‘ভাই যন্ত্রণায় আছি। কিচ্ছু করার নাই। চাকরির স্বার্থে সব সহ্য করে যাচ্ছি। মুখে মাস্ক পরে কাজ করি। এই যন্ত্রণা যে কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। রোগীদের নানা কথায় আমরাও ত্যক্ত-বিরক্ত।
তিনি বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে এভাবে দেয়াল ভাঙার কাজ করাটা কোনোমতেই ঠিক হচ্ছে না। এতে শুধু রোগীরাই যন্ত্রণা পাচ্ছে না, পাশাপাশি হাসপাতালের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানান, নিয়ম হলো সংস্কার কাজ চললে চিকিৎসা ওয়ার্ড বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। আমরা রোগীদের সেবা দিতে চাই। সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখার চিন্তা ভাবনা চলেছে। আমাদের কাজ আমরা করতেছি। কিন্তু সংস্কার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপূর্তের লোকজন নিয়মকানুন মানছে না। তার ইচ্ছা করলে ওয়ার্ডে টাইলস কাটার কাজ না করে বাইরেও করতে পারে তাহলে শব্দ দূষণ হবে না।
সংস্কার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আমিনুর রহমান গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানান, সংস্কার কাজের কারণে সাময়িক সমস্যা হচ্ছে তবে তা বেশি দিন নয়। কাজটা শেষ হলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সুবিধা হবে। আমরা অন্যান্য ওয়ার্ডগুলো সুন্দরভাবে সংস্কার করেছি সেখানেও রোগীদের স্থানান্তর করা যাবে। তবে সমস্যাটা একেবারে সাময়িক। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি ডা: চৌধুরী মো: ইকবাল বাহার নয়া দিগন্তকে জানান, সবার আগে রোগীর বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে হাসপাতালের উন্নয়ন হোক এটি যেমন চাই, তেমনি উন্নয়নের কারণে কোনো অসুস্থ মানুষ আরো অসুস্থ হোক এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ৩ শ’ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসক তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোতালেব হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, কনট্রাকশনের কাজ করলে কিছু তো সমস্যা হবেই। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত রোগীদের সমস্যার সমাধান করার। নতুন ওয়ার্ড চালু হলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement