২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবিকার তাগিদে থেকে বের হয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো ওরা

জীবিকার তাগিদে থেকে বের হয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো ওরা। ছবি - নয়া দিগন্ত।

জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার ভোরে ঘর থেকে বের হয়েছেন ৪ সিএনজি অটোরিক্সা চালক। রুটি রোজগারের একমাত্র অবলম্বনটি ধুয়ে-মুছে স্ট্যান্ডে সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। কিছু বুঝে উঠার আগেই হটাৎ একটি দ্রুতগামী ট্রাক তাদের উপরে উঠে যায়। পাচঁটি সিএনজি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে। এরপর ট্রাকে নিচ থেকে উদ্ধার করা হলো ৪টি লাশ। মুহুর্তে ভেঙ্গে গেল এক একটি পরিবারের স্বপ্ন। কোথায় যাবে তাদের সংসার? কিভাবে চলবে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা এই প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়। এক গ্রামের ৩ সিএনজি চালক এভাবে একসাথে চলে যাবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার।

মঙ্গলবার সকাল ৬টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘী বাজার স্ট্যান্ডে এই ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার আছরের নামাজের পরে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়েছে।

কে নেবে শাহ আলমের ছেলেদের পড়ালেখার দায়িত্ব ?
সিএনজি-অটোরিক্সা চালক শাহ আলম (৫০)। সিএনজি-অটোরিক্সা চালিয়ে সংসার চালান তিনি। ৩ ছেলে, স্ত্রী আর মা নিয়ে সংসার তাঁর। বড় ছেলে জাহেদুল আলম (১৩) পড়েন মিঠাছরা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে। মেঝ ছেলে শাহেদুল আলম (১০)। সেও বড় ভাইয়ের সাথে একই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলে শাকিব আল হাসান (৬) পড়েন শাহ কালা (রাঃ) বিদ্যা নিকেতনের শিশু শ্রেণীতে। শাহ আলম ভোরে বের হয়ে ফিরেন গভীর রাতে। মৃত্যুর পূর্বে কারো সাথে তেমন কথাও হয়নি তার। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবার অনুপস্থিতিতে কে ধরবে সংসারের হাল। তার ছেলেদের পড়ালেখা কি শেষ পর্যন্ত চলবে। এমন হাজারো প্রশ্ন করতে করতে বিলাপ করতে থাকেন শাহ আলমের মা।

আদরের সন্তানের নিথর দেহ নিয়ে কাঁদছেন মা
কামরুল ইসলাম (২২) প্রতিদিন ভোরে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে ফিরেন রাতে। ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে মেঝ সে। মা, বাবা আর ভাই বোনদের নিয়ে তার সুখের সংসার। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারায় সে। কামরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় আত্মীয়-স্বজন আর এলাকাবাসী পুরো বাড়ী ঘিরে রেখেছে। স্বজনদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল অনেক দূর থেকে। কামরুলের বড় ভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, কামরুলকে গাড়ি না চালানোর জন্য ঘর থেকে বারবার নিষেধ করা হয়েছিলো। তবুও সে গাড়ি চালাতো।

ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তারা ?
মঙ্গলবার সকালে মোশাররফ হোসেন ও তার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন এক সাথে ঠাকুরদিঘী বাজারে নাস্তা করেন। নাস্তা শেষে মোশাররফ সিএনজি স্ট্যান্ডে চলে যায় আর আনোয়ার বসে টিভি দেখছিলেন। মোশাররফ যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে বিকট একটি আওয়াজ হয়। আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি দোকান থেকে বের হয়ে মহাসড়কে গিয়ে দেখি ৩-৪টি সিএনজি-অটোরিক্সাকে ধুমড়ে মুছড়ে গিয়ে একটি ট্রাক মহাসড়ক থেকে নীচে নেমে গেছে। ট্রাকের সামনে গিয়ে দেখি ট্রাকের চাকার নীচে আরো ৪-৫ জনের সাথে আমার আদরের ছোট ভাইও পড়ে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম নেওয়া পথে তার মৃত্যু হয়। চোখের সামনে এভাবে সে চলে যাবে তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। তানহা তাবাচ্ছুম (৪) নামের তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলে নিহত হন সিএনজি চালক উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের শাহ আলম (৫০), দিদারুল আলম (৩৫), মিরসরাই সদর ইউনিয়নের গড়িয়াইশ গ্রামের মোঃ নবীর ছেলে কামরুল ইসলাম (৪৫), সিএনজি-অটোরিক্সা যাত্রী উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের জমাদার গ্রামের মোঃ মহিউদ্দিন (৬০)। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) নেওয়ার সময় পথে মারা যান আরেক চালক দুর্গাপুর ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মোশাররফ হোসেন (২৫)। এসময় আহত হন দুর্গাপুর ইউনিয়নের সিএনজি-অটোরিক্সা চালক মোঃ লিটন (২৮), মোঃ সোহেল (২৪), মোঃ নবী (২৮), ট্রাক চালক খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার খাগড়াবিল গ্রামের মোশাররফ হোসেনের ছেলে রবিউল হক শাহীন (২২)। শাহীনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জোরারগঞ্জ থানায় নেওয়া হয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চালকদের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) ইয়াছমিন আক্তার কাকলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাইফুল কবির, দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান বিপ্লব। তারা উপজেলা পরিষদ থেকে নিহতদের পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দেন।


আরো সংবাদ



premium cement