১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


হংকং: সঙ্কুচিত হচ্ছে মীমাংসার পথ, উপায় কী চীনের?

হংকং: সঙ্কুচিত হচ্ছে মীমাংসার পথ, উপায় কী চীনের? - বিবিসি

হংকংয়ে টানা তিন মাস ধরে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ যেভাবে দিনকে দিন সহিংস চেহারা নিচ্ছে, তাতে তার ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগে পড়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী সৈয়দ ইকরাম ইলাহি। পঁচিশ বছর ধরে হংকংয়ে বসবাস করছেন মি. ইলাহি। প্রধানত বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করে তার প্রতিষ্ঠান।

টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে ইলাহি বলছিলেন, তার ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা উদ্বেগ তার আগে কখনো হয়নি। ‘আমার ক্রেতারা আমাকে নতুন করে অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছে। তাদের ভয় আমি যদি সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারবো কিনা...শুধু আমার নয় সব ব্যবসারই এক অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে।’

‘আমি চোখের সামনে দেখছি অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হচ্ছে। হোটেলগুলোতে লোক আসছে না। বড় বড় দোকানগুলোর বিক্রিবাটার অবস্থাও খারাপ।’

মি. ইলাহি বলেন, হংকংয়ের খুচরা ব্যবসায়ের প্রধান ক্রেতা ছিল চীনারা। প্রতিদিন ট্রেনে, বিমানে, ফেরিতে করে চীন থেকে হাজার হাজার লোক আসতো হংকংয়ে কেনাকাটা করতে, কারণ বাচ্চাদের দুধ, ডায়াপার, বিদেশি ব্রান্ডের অনেক পণ্য চীনের চেয়ে এখানে সস্তা।

‘চীনাদের আসা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়, ফলে খুচরা ব্যবসার অবস্থা খারাপ।’

ইলাহি জানালেন, হংকংয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা সমিতি মঙ্গলবার এক বৈঠকে বসছেন যেখানে পরিস্থিতি নিয়ে তারা কথা বলবেন। তার নিজের আশঙ্কা সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে ক্রেতারা হয়তো একসময় হংকং-এর বদলে সরাসরি চীন থেকে পণ্য কেনার কথা চিন্তা করতে পারে।

এই ব্যবসায়ী বলছেন, তাদের মনে হচ্ছে আপোষ মীমাংসার রাস্তা দিনকে দিন যেন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, এবং পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠছে। ‘আগেও এখানে বিক্ষোভ হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের ভাঙচুর, আগুন কখনো দেখিনি।’

সংবাদদাতারাও বলছেন, শনি ও রোববার বিক্ষোভে যে ধরণের ভাঙচুর, সহিংসতা হয়েছে, তা গত তিনমাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

আজ (সোমবার) গ্রীষ্মের ছুটির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে, কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস বয়কট করেছে।

বিক্ষোভের আয়োজকদের পক্ষে দাবি করা হয়েছে, ২০০টি হাই স্কুলের ১০,০০০ শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করেছে। এতদিন বিক্ষোভ হচ্ছিল শুধু সপ্তাহান্তে অর্থাৎ শনি ও রোববার। কিন্তু আজ (সোমবার) সকালে অনেক বিক্ষোভকারী রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

পরিস্থিতি বিপজ্জনক

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়না'র অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ এবং বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াইতে এমনিতেই চীন খুব চাপে রয়েছে। এখন হংকং নতুন এক বিষফোঁড়া হিসাবে যোগ হয়েছে।

‘পরিস্থিতি বেশ খারাপ,’ বলছিলেন ড. আলী।

তিনি বলেন, চীনা নেতৃত্বের ভেতরে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠছে যে হংকংয়ের আন্দোলন বিক্ষোভে কিছু দেশ - বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র - ইন্ধন দিচ্ছে।

‘আপনি গত কয়েকদিনের চীনা সরকারি গণমাধ্যমের খবর, মতামত দেখলে সেটা বুঝতে পারবেন। চীন মনে করছে হংকংয়ের বিক্ষোভ এখন আর শুধু হংকংয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর ক্রোধের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। এটাকে তারা দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য বিরোধের একটা প্রতিফলন হিসাবে।’

গত কদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী বেশ কজন কর্মকর্তা এবং রাজনীতিকরা একই ধরনের কথা বলছে যে হংকংয়ে চীনারা সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে, সহিংসতা হলে চীনের সাথে কোনো বাণিজ্য আলোচনা হবেনা।

এছাড়া হংকংয়ের বিক্ষোভকারীদের কিছু নেতার সাথে সম্প্রতি মার্কিন একজন কূটনীতিক গোপনে কথা বলেন।

‘চীন এখন এসব ঘটনাকে উল্লেখ করে বলছে যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ের বিক্ষোভে উস্কানি দিচ্ছে।’ 

অব্যাহত বিক্ষোভে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী। দোকানের শাটার অর্ধেক বন্ধ। দোকানের নিরাপত্তা ক্যামেরায় কালি স্প্রে করছে এক বিক্ষোভকারী।

আমেরিকার স্বার্থ কী?

কিন্তু হংকংয়ে অস্থিরতায় ইন্ধন কেন দেবে যুক্তরাষ্ট্র? তাদের স্বার্থ কী? ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, চীনের অভিযোগের পেছনে হয়তো যথার্থ কারণ রয়েছে।

‘গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতিমালায় বার বার বলা হয়েছে যে চীন এখন তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। সুতরাং চীনকে নীচে নামাতে সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক সব ধরণের ব্যবস্থা তারা নেবে।’

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতির ওপর বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ যে মোট যে আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে, তার সবগুলোতেই চীনকে 'এক নম্বর" প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কী করবে চীন?

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাদের এই স্বশাসিত অঞ্চলকে শান্ত করতে বেইজিংয়ের সামনে এখন রাস্তা কী? ড. মাহমুদ আলী বলছেন, যদিও সরাসরি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায়না, কিন্তু সেটা হয়তো চীন একবারেই তাদের শেষ উপায় হিসাবে ব্যবহার করবে। তার মতে, চীন এখনও হংকংয়ের প্রশাসনের মাধ্যমেই বিক্ষোভ ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে রাখার পথেই রয়েছে।

তিনি বলেন, গত কদিনের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট যে, বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। আইনের আওতায় তাদের নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

হংকংয়ের দুটো রাজনৈতিক দলের তিনজন নেতাকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। রেল স্টেশনে ভাঙচুরের অভিযোগে গত দু'দিনে ৩৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

ড. আলী বলছেন, ‘এতদিন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এখন আইনের পথ নিচ্ছে। মামলা হলে বিচারের শুনানির সময় ভাঙচুর ক্ষয়ক্ষতির কথাবার্তা বেরিয়ে আসবে। হংকংয়ের প্রশাসন হয়তো ধারনা করছে হংকংয়ের ক্ষতি করা হচ্ছে, ব্যবসার ক্ষতি করা হচ্ছে - এসব শুনে এই নেতাদের জনসমর্থন কমবে।’

তবে এই কৌশল যে কাজে দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সেক্ষেত্রে, ড. আলীর মতে, অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়ে হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব রক্ষাটাকেই চীনের কাছে এক নম্বর অগ্রাধিকার হবে।

‘চীনা কর্মকর্তারা বার বার এটাই বলার চেষ্টা করছেন, চাপের কাছে কখনই তারা নতি স্বীকার করবেন না।’


আরো সংবাদ



premium cement

সকল