০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভুলো না আমায়

চারাগল্প
-

জ্যামে আটকা পড়েছে কাতার থেকে দুই ঘণ্টা আগে দেশে ফেরা রানা। অফিসিয়াল কাজে প্রায়ই তাকে বিভিন্ন দেশে উড়াল দিতে হয় এবং প্রতিবার দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে রাজপথে নামলে এ রকম টুকটাক জ্যামে আটকা পড়ার ইতিহাস তার পুরনো।
প্রাইভেট কারে বসে আছে রানা। ডান পাশের সাদা গাড়িটির ভেতরে যে মেয়েটি মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত, তাকে দেখতে অনেকটা পারুলের মতো লাগছে। পারুল রানার স্ত্রী। সাত বছর আগে ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে। রানার পরিবার প্রথম থেকেই এ বিয়ের বিপক্ষে ছিল। কারণ পারুলদের একে তো অগাধ সম্পত্তি নেই, তার ওপর পারুল সৎমায়ের সংসারে অনাদরে বেড়ে ওঠা অল্প শিক্ষিতা মেয়ে। সেই মেয়েকে বিয়ে করে এনে রানা যখন বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়ায় এবং তারা পারুলের জীবন বর্ণনা শোনে, তখন থেকেই পারুল বুঝতে পেরেছে শ্বশুর-শাশুড়ি তার ওপর সন্তুষ্ট না। রানার বাবা চেয়েছেন, তার বন্ধুর মেয়ে মল্লিকাকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনবেন। কিন্তু রানা কখনো মল্লিকাকে মনে জায়গা দেয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। কারণ তার মনের সবটুকু জায়গাজুড়ে তখন কেবল পারুলের বসবাস।
দাম্পত্য জীবনের এক বছর যেতেই একটি দুর্ঘটনা ঘটে। হানিমুন শেষে কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে তলপেটে মারাত্মক জখম হয় পারুলের। ডাক্তারের চিকিৎসায় অল্পদিনে সুস্থ হলেও পারুল মা হওয়ার ক্ষমতা চিরতরে হারায়।
সংসারে বংশের প্রদীপ কখনো জ্বলবে নাÑএই সত্য মেনে নিতে পারেনি রানার বাবা-মা। রানাকে তাগিদ দিয়ে তারা জানায়, ‘এই মেয়েকে ত্যাগ করে মল্লিকাকে বিয়ে করো। আমরা নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে চাই।’ রানাও বাবা-মাকে সাফ জানায়, ‘পারুলকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। আমার সন্তান লাগবে না। পারুলই আমার সব।’
আড়াল থেকে এসব শুনে শোকে ভেঙে পড়ে পারুল। স্বামীকে জানায়, ‘আমি তোমার জীবনের অভিশাপ। আমি চলে যেতে চাই। আমার জন্য তুমি আজীবন নিঃসন্তান থাকবে, তা আমার সহ্য হবে না।’ রানা পারুলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘যে যাই বলুক তোমাকে, তুমি আমার কথা ভেবে সব সহ্য করে নাও। তুমিই আমার সব।’ স্বামীর এমন কথায় চোখের পানি মুছতে গিয়ে পারুল ভাবে সে বড় ভাগ্যবতী।
রানার অগোচরে দিন দিন পারুলের ওপর মানসিক নির্যাতন বাড়ে। রানার বাবা-মা মনে করেনÑ এই মেয়েকে মানসিক নির্যাতন দিলে সে অসহ্য হয়ে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হবে।
মানসিক নির্যাতনের হারটা ক্রমে বাড়তে থাকলেও পারুল কখনো রানার কাছে সেই অভিযোগ তোলেনি। কারণ রাগে-ক্ষোভে রানা বাবা-মাকে দু-চারটি কটু কথা শুনিয়ে দেবে, সেটি পারুল কখনো চায় না।
রাস্তার জ্যাম কেটে গেল। নিরাপদে বাসায় ফিরে রানা। বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে, পারুল কই! পারুলকে দেখা যাচ্ছে না কেন! রানার মা জানান, ‘তুমি কাতার যাওয়ার তিন দিন পর থেকে পারুল নিখোঁজ।’ এমন সংবাদ শুনবে, আশা করেনি রানা। পারুল নিখোঁজ মানে কী! কোথায় গেল!
পরদিন সকালে কাজের মেয়ে বিলকিস চুপি চুপি এসে রানার হাতে একখানা চিঠি দিয়ে বলে, ‘ভাবি বলে গেছেন আপনি এলে এ চিঠি যেন আপনাকে দিই।’
পারুল সে চিঠিতে লিখেছেÑ‘আমাকে ক্ষমা করো রানা। চলে গেলাম তোমাকে ছেড়ে। আমার কারণে তুমি সারা জীবন নিঃসন্তান থাকবে কেন! যার কোনো সন্তান নেই, তার জীবনেরও দাম নেই। এই যে তুমি সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে মাস শেষে এত টাকা আয় করো, সেসব কার জন্য? এসব ভাবতে গেলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। তা ছাড়া তোমার বাবা-মাও আমাকে কখনো মনে একটু জায়গা দেননি। তারা কেবল মল্লিকার সাথে তোমাকে বিয়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজছেন। আমি চলে গেলেই তারা খুশি। তাই চলে গেলাম। সৎমায়ের ঘরে গিয়ে নির্যাতন সইবার ইচ্ছে নেই। আমি আবিরপাড়া যাবো। সেখানে আমার এক খালা আছেন, আলেয়া খালা। তার কাছে থাকব। তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ রানা। জীবনে মল্লিকা বা অন্য কাউকে যখনই বিয়ে করো, এই আমাকে ভুলে যেও না। মনে রেখো সব সময়। ভুলো না আমায়।’
চিঠি পড়ে চোখ ভিজে গেল রানার। সে এখনই আবিরপাড়া যাবে। আলেয়া খালার বাড়ি থেকে পারুলকে নিয়ে আসবে।
২.
আবিরপাড়া এসে আলেয়া খালার বাড়ি খুঁজতে অসুবিধে হয়নি রানার। কিন্তু এখানে এসে এত বড় এক দুঃসংবাদ শুনবে, আশা করেনি। সাত দিন আগে আলেয়া খালার ঘরে গভীর রাতে বিদ্যুতের ছেঁড়া তার থেকে আগুন লেগে সারা ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘরে যারা ছিল আলেয়া খালা, তার স্বামী, দুই ছেলে আর পারুলসহ সবাই আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। লাশগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।
এমন সত্য জেনে রানা শিশুর মতো অঘোরে কাঁদতে লাগল। পারুল বেঁচে নেই, এ কথা মানতে বড় কষ্ট হচ্ছে রানার। পারুল রানার জীবনে এতটাই মিশে গেছে যে, তাকে বাকি জীবন আর ভুলতে পারবে না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।


আরো সংবাদ



premium cement