৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্রস্তাবিত পরিবহন আইন দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি

-

মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে এ সম্পর্কিত আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানির ঘটনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি ঘটলে এ সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) ৩০২, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে দণ্ডবিধির কোন ধারায় মামলা হবে তা তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী সংঘটিত দুর্ঘটনায় তদন্তে যদি বোঝা যায় চালক স্বেচ্ছায় অপরাধ করেছে, কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে পিষে দিয়েছে, সে ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ শাস্তির ধারা প্রয়োগ হবে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রত্যেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট করে বরাদ্দ থাকবে। অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে, পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ব্যক্তি অপ্রকৃতিস্থ, অসুস্থ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম, মদ্যপ বা অপরাধী হলে সরকার তার ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি সর্বোচ্চ চার মাসের জেল বা ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই অপরাধে ছয় মাসের জেল ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রাখা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে এই অপরাধের সাজা ছিল তিন মাসের জেল বা দুই হাজার টাকা জরিমানা। পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীদের সাথে আলোচনার পর সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতেই নতুন আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে পাস হলে তা সড়ক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগও জরুরি। আইনটি যাতে হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে সরকারকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম ধরতে বিআরটিএর দুর্নীতি ও অনিয়মের অবসানও জরুরি। বলা যায়, লাইসেন্স ও ফিটনেসের ক্ষেত্রে যে অরাজকতা চলছে, তার জন্য তাদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম দূর না হলে নৈরাজ্য ঠেকানো কঠিন হয়ে যে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে সড়কে বিশৃঙ্খল চলাচল এবং আইন-কানুন না মানা। অন্যান্য কারণের মধ্যে আছেÑ ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল, একই রাস্তায় দ্রুত ও ধীরগতির যানবাহনের একত্রে চলাচল, অদক্ষ গাড়িচালক ও সড়কের দুরবস্থা। সড়ক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। মৃত্যুর পাশাপাশি বাড়ছে পঙ্গু হওয়া মানুষের সংখ্যাও।
নিষিদ্ধ হলেও এখনো অনেক চালককেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। যেকোনো মূল্যে এটি বন্ধ করতে হবে। অদক্ষ চালকেরা যেন লাইসেন্স না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেন রাস্তায় নামতে না পারে, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারেও শৃঙ্খলা মানতে হবে। জানা যায়, লেগুনা, হিউম্যান হলার, টেম্পো বা এ ধরনের কিছু গাড়ির চালকদের বেশির ভাগেরই লাইসেন্স থাকে না। অপ্রাপ্তবয়স্করাও এসব গাড়ি চালায়। এমনকি খোদ রাজধানীতেও এদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। অভিযোগ আছে, পুলিশকে নির্ধারিত দৈনিক অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে এরা গাড়ি চালায়। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নসিমন, করিমন, টমটম, ভটভটি ইত্যাদি নামের কিছু যানবাহন ইদানীং মহাসড়কেও চলতে দেখা যায়, যেগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি এবং ইঞ্জিনগুলো যানবাহনেরই নয়। এগুলোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। সম্প্র্রতি এই যানবাহনগুলো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। অথচ কোনো এক অদৃশ্য কারণে এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক সময় যাত্রীবাহী বাসও দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, গাড়ি চালাতে না জানলেও শুধু কিছু টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স পাওয়া যায়। এমন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
জীবনধারণের একান্ত প্রয়োজনেই মানুষকে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করতে হয়। এটা কোনোভাবেই মৃত্যুফাঁদ হতে পারে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দুর্ঘটনার কারণ সংক্রান্ত পুলিশি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলেছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ঘটে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement