মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নির্বাচিত হন (ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯) সৌদি রাজকুমারী রিমা বিনতে বন্দর আল সউদ। একজন মন্ত্রী মর্যাদার পদে ১১তম দূত হিসেবে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে একজন নারী হিসেবে যোগদান করে দেশটির জন্য রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। সৌদি রাজ্যে নারী ক্ষমতায়নে জোরালো বক্তব্য রেখে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন রিমা। সৌদিতে নারীদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখেন তিনি।
রাজধানীর রিয়াদে জন্মগ্রহণ করা এই সফল নারী অনেক বছর বাবার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। কেননা তার বাবাও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। রিমা জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে জাদুঘর বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনার এক ফাঁকে তিনি প্যারিসে এল ইনস্টিটিউট ডু মনডে আরবি এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে সাকলার গ্যালারি অব আর্ট বিষয়ে ইন্টার্নি করেন। পরে শিকাগো ফিল্ড মিউজিয়ামে কিউরেটর হিসেবে যোগ দেন। জাদুঘর বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করার পর রিয়াদে ফিরে যান। প্রায় এক দশক ধরে রিমা বেসরকারি, সরকারি ও মানবহিতৈষী বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেন। ২০০৫ সালে সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার পর তিনি নারীদের ব্যায়ামাগারের একটি প্রতিষ্ঠান ইবরিন তৈরি করেন। এরপর আল জামা এলএলসি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হন। খুচরা বিক্রির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে কাজ করতে থাকেন। রাজ্যে নারীদের কর্মক্ষেত্রগুলোকে সংহতিপূর্ণ করার জন্য রিমা কর্মক্ষেত্রে বিশেষ নজির সৃষ্টি করতে থাকেন।
অনেকেই বলেন, রিমা ছিলেন একজন সক্রিয় উদ্যোক্তা। বারাবক্স নামক একটি বিলাসী হান্ডব্যাগ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও সৃজনকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ২০১৩ সালে। একই বছর তিনি আলফ খায়ের নামে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সৌদি নারীদের জন্য পেশাগত মূলধন গঠন করা। এই প্রতিষ্ঠানের একটি কাজ ছিল সৌদি সম্প্রদায়ের সার্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতার ধারণা সৃষ্টি করা। বছরব্যাপী অভিযানের একসময়ে পৃথিবীর বিখ্যাত হিউম্যান অ্যাওয়ারনেস রিবন সৃষ্টি করেন, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে অন্তর্ভুক্ত হয়।
যোগ্যতাবলে রিমা বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই পদে আসার উদ্দেশ্য হলো নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে সহযোগিতা করা। এ দিকে ম্যাস পার্টিসিপেশন ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে তিনিই প্রথম নারী, যিনি সৌদি সাম্রাজ্যে বহুবিধ ক্রীড়াসংক্রান্ত সংগঠন পরিচালনা করেন এবং সম্প্রদায়কে অধিকতর কর্মক্ষম জীবন পদ্ধতি উপহার দেন। ২০১৬ সাল থেকে সৌদি জেনারেল স্পোর্টস অথরিটি বা জিএসএ’র পরিকল্পনা ও উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটি সৌদির ক্রীড়া অর্থনীতি এবং কৌশলগত অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করে। একই বছর তাকে জেনারেল স্পোর্টস অথরিটির নারীসংক্রান্ত বিষয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। ২০১৭তে সৌদি ফেডারেশন ফর কমিউনিটি স্পোর্টস এবং প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। তার প্রথম অর্জন হচ্ছে বিদ্যালয়ে মেয়েদের শারীরিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়।
একজন সফল উদ্যোক্তা, মানবহিতৈষী, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখার জন্য তাকে শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম ক্রিয়েটিভ স্পোর্ট পদ প্রদান করা হয়। রিমা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সদস্য। অধিকন্তু উইম্যান ইন স্পোর্টস কমিশন এবং সৌদি অ্যারাবিয়ান অলিম্পিক কমিটিরও সদস্য।
নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নারীদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফাস্ট কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাকে সবচেয়ে সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এমনকি ২০০ সর্বাধিক ক্ষমতাশীল আরব নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাশাপাশি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিডিং গ্লোবাল থিংকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কারণ অর্থনীতিসহ অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রে তিনি নারীদের জন্য অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি করেন।
রিমা সবার উদ্দেশে বলেছেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ত করা মানে একটি বিবর্তন, কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতি নয়। অর্থনীতিতে নারীর সম্পৃক্তকরণ বিশ্বে তাদেরকে অধিকতর আবিষ্কারের বীথিকা (দুই পাশে গাছপালা দিয়ে সজ্জিত রাস্তা) সৃষ্টি করে তাদের আত্মনির্ভরশীল করবে। তিনি আরো বলেন, সৌদি আরবে মোট জনসংখ্যার যদি অর্ধেক নারী হয়, তবে তারা কর্মবিমুখ থাকবে না। তিনি অগণিত নারীকে শিশুযতœ এবং যুবতী মেয়েদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নেন। কর্মক্ষেত্রে নারীরা তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে যাতে কোনো সমস্যায় না পড়তে হয় সে ব্যবস্থাও করেন।
হারভে নিকোলস নামক স্থানে একটি কর্মসূচি নেন, নারীদের পরিবহন বাবদ ব্যয় মেটানোর জন্য। কারণ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত দেশটিতে নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। তার এসব প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক নীতি নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধাবিপত্তি শিথিল করে। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, যা বাধা-বিপত্তির মধ্যে ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত।
রিমা সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে সৌদিতে সৃজনশীলতা সৃষ্টি করেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে নারীর কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করেন। এমনকি তিনি জাহরা ব্রেস্ট ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত রাজধানী রিয়াদে। সংস্থাটির উদ্দেশ্য হলো সমস্যার শুরুতেই এই রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ এবং স্তন ক্যান্সার নামক মারণব্যাধিটির পরীক্ষা করে ক্রমেই এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য সঠিক চিকিৎসা দেয়া। তিনি মাউন্ট এভারেস্ট নামক একটি ক্যাম্পে স্তন ক্যান্সার বিষয়ে নারীদের সচেতন করেন। তার পুরো নাম রিমা বিনতে বন্দর বিন সুলতান বিন আবদুল আজিজ আল সউদ হলেও সবাই তাকে ডাকেন রিমা নামে।