পরবাসে ঈদ
- আঞ্জুমান আরা
- ০৪ জুন ২০১৮, ০০:০০
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অনেকের বাস এখন ভিনদেশে।
স্বামী-সন্তান নিয়ে সেখানেই কাটে জীবন। কেমন তাদের ঈদ উৎসব। এমনই কয়েকজন প্রবাসীর কথা নিয়ে সাজানো হলো আজকের পাতা। অনুলিখন আঞ্জুমান আরা
ঈদ নিয়ে আসে উৎসব আনন্দ
Ñ তাসলিমা পলি
উদ্যোক্ত, সরকার ফুডস
ডেনফোর্থ, টরন্টো, কানাডা
আজ ২২ বছর ধরে আমি কানাডা প্রবাসী বাঙালি মেয়ে। মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় শফিকুল ইসলাম সরকারের সাথে। প্রবাসী স্বামীর হাত ধরে আমারও শুরু হয় প্রবাস জীবন। সুদূর কানাডার টরন্টো শহরেই আমার জীবনের বাইশটি বছর কেটে গেছে আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে। এসএসসি পাশ করা ছোট্ট কিশোরী এই আমি জীবনে নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও তেমন থাকা হয়নি। কিন্তু জীবনের তাগিদে একেবারে সাত-সমুদ্র তের নদী পার হয়ে সেই শ্বেতভল্লুকের দেশে! প্রবাসজীবনের প্রথমটায় মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হতো। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া হতো।
কৈশোরের দুরন্ত সময়গুলো যেখানে সবাই হইহুল্লোড় করে দাপিয়ে বেড়াত এবাড়ি ওবাড়ি অথবা কদম-বেলী গাছের তলায়, আমি তখন দিব্বি সংসার করে যাচ্ছি স্বামী ও দুই সন্তান পিংকী, সাকিবকে নিয়ে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জীবনের পরতে পরতে প্রতিটি দিনের শেষে রাত পার করার মধ্য দিয়ে। কারণ বিদেশে ঘর-গৃহস্থালির এ টু জেড সব কাজই করতে হতো এক হাতে এই আমাকে। পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসায়ও হাত লাগাতে হয়েছে। তারপর আমি আজকের টরন্টো শহরে বাঙালি ফুডের দোকানের মালিক। এই এলাকার দেশী-বিদেশী সবাই এর নাম জানে ও চেনে।
ঈদ, হ্যাঁ, ঈদুল ফিতর ৩০ দিন রোজার শেষে প্রত্যেকটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য ঈদ খুবই আনন্দের। আমরা কানাডা প্রবাসী সবাই ঈদকে ভীষণভাবে উপভোগ করি। সপ্তাহের প্রতিটি দিন যেহেতু খুবই ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে যায় তাই রোজা ও ঈদটা আমরা খুব ভালোভাবেই পালন করি। এবার কানাডায় ১৭ ঘণ্টা সময় রোজা রাখতে হচ্ছে। ভোর ৪টায় ফজরের আজান আর ইফতারি করছি রাত ৯টায় মাগরিবের নামাজ শেষে কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এশা ও তারাবির নামাজ শেষ করতে করতে রাত ১২টা-১টা। দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার সেহরি। তারপর ফজরের নামাজ শেষ করে চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকাল ৮টা থেকে ব্যবসার কাজ, ঘরগৃহস্থালির গোছগাছ। সবমিলিয়ে ভীষণ ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে। তার পরও নিয়মিত রোজা ও তারাবি পড়তে মসজিদে যাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে। আমরা টরন্টোতে অবস্থিত ‘বায়তুল জান্না ইসলামিক সেন্টার’ নামক মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করি। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মুসলমান নর-নারী একত্রে জামাতে নামাজ পড়ি।
সারা সপ্তাহ আমরা প্রবাসীরা যেহেতু কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাই, তাই মধ্যে মাঝে পরিবারের সবাইকে নিয়ে লং ড্রাইভে এক-দুই সপ্তাহের জন্য কোথাও বেড়াতে যাই। আমি রোজার আগের ১৫ দিন আমেরিকার সাতটি শহরে সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ ড্রাইভ করে বেড়িয়ে এসেছি। কিন্তু এতটা পথ শুধু ড্রাইভ করে যাওয়াতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারপরও এই রোজায়, নামাজ, খতম তারাবি পড়ছি। অপেক্ষায় আছি কবে ঈদ হবে সবাই মিলে আনন্দফুর্তি করব। আমাদের এখানে রোজার সময় ছুটির দিনগুলোতে কারো-না-কারো বাসায় ইফতারির পার্টির আয়োজন হয়। আমি নিজেও কখনো করি। তবে ইফতারির পার্টির পর তারাবি নামাজ আদায় করতে একটু সমস্যায় পড়তে হয়। তাই ঈদের নামাজ জামাতে পড়ার পর থেকে আশপাশের ভাবীদের বাসায় সকাল-দুপুর-বিকেল ও রাতের দাওয়াত খেতে খেতেই খুব আনন্দ উৎসবে দিনটা পালন করা হয়। কয়েক বছর আগে আমি বাংলাদেশে ঈদ করতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানকার অবস্থা দেখে আমি একরকম হতাশ। রোজা-নামাজ-তারাবিহ সব ঠিকঠাকমতোই হচ্ছে কিন্তু ঈদে প্রবাসে বসে আমরা যেমন আনন্দ করছি, আশপাশের সবার সাথে বাংলাদেশে এখানকার সবাই যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। পুরুষেরা নামাজ শেষে ঘরে ফিরে ঘুমায় আর মহিলারা রান্না করে ঘরের লোকজনদের পেটপুরে খাওয়ায়। কিন্তু বিভিন্নজনের বাসায় সে রকম আনন্দফুর্তি নিয়ে বেড়াতে যায় না। খুব কম লোকই বউবাচ্চা নিয়ে বের হয়। তবে সন্ধ্যায় টিভিতে ঈদের প্রোগ্রামগুলো দেখতে বসে যায়। সামান্য কিছু পরিবার ঈদের আগের রাতে শপিংয়ে থাকে। পার্লারে গিয়ে তরুণী ও শিশুরা হাতে মেহেদি লাগায়। এই হচ্ছে বাংলাদেশের ঈদ উৎসব। আমি ভুল না ঠিক বলছি তা জানি না। তবে আরো অনেকের কাছে শুনেছি বাংলাদেশের গুটিকয়েক পরিবারের মেয়েরা ঈদে নামাজ পড়তে যায়, তাও সব মসজিদে সে ব্যবস্থাও নেই। অন্য দিকে, প্রবাসে থাকা ৯৯ শতাংশ মেয়েরা ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়। তা ছাড়া, সবার বাসায়ই সকাল, দুপুরে, বিকেলে অথবা রাতে একসাথে বসে বন্ধুবান্ধব বা আশপাশের সবাই মিলে ভূরিভোজের আয়োজন হয়। অনেক সময় তা মাসব্যাপীও পুনর্মিলনী হিসেবে পালিত হয়। আসলে আমরা যদি এই যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু স্বস্তি পেতে চাই তাহলে সবার সাথে সৌহার্দ পূর্ণ সম্পর্ক রাখা খুবই দরকার। তা না হলে মানুষ তো এক দিন যন্ত্র হয়ে যাবে।