৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কানাডার নির্বাচনে যেভাবে হস্তক্ষেপ করেছে ভারত ও চীন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে কানাডার জাস্টিন ট্রুডো - ফাইল ছবি

‘চীনের এক উচ্চ বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে লিবারল পার্টির প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। নির্বাচনে হাজার হাজার ডলার ঢেলেছে চীন যদিও এর পরিমাণ এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। ভারত সরকারের এক প্রক্সি এজেন্ট কানাডায় ভারতপন্থী রাজনীতিবিদদের অবৈধভাবে অর্থায়ন করছে।’

এমন অনেক অভিযোগ উঠে এসেছে কানাডার নির্বাচনে বিদেশী হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে তদন্তে। গত দুই সপ্তাহ ধরে কানাডায় এই মামলার শুনানি চলছে।

কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, তদন্ত কমিটির কাছে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার তরফে পেশ করা সংশোধিত নথিতে ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে তোলা একাধিক অভিযোগের উল্লেখ রয়েছে। সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে এই নথিগুলো।

একইসাথে কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা সিএসআইএস-এর তরফে সতর্ক করে বলা হয়েছে, পেশ করা প্রতিবেদনে এমন তথ্য থাকতে পারে যা একটি মাত্র উৎস থেকে জানা গিয়েছে, তথ্য অসম্পূর্ণ কিংবা পুরোপুরি পরীক্ষা করা হয়নি।

সাম্প্রতিকালে চীন ও ভারতের বিরুদ্ধে কানাডার বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। ভারত অবশ্য এই অভিযোগকে 'ভিত্তিহীন' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। চীনও অস্বীকার করেছে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ।

কিন্তু রাজনীতিবিদদের একাংশ জানিয়েছেন এই হস্তক্ষেপের প্রভাব তাদের রাজনৈতিক জীবনে দেখা গিয়েছে। কানাডার একাধিক প্রবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ঝুঁকির কথা বলেছেন এবং সে জন্য দায়ী করেছেন তাদের নিজেদের দেশের সরকারের সঙ্গে যুক্ত এজেন্টদের।

রিপোর্টে যা বলা হয়েছে
তদন্তে সময় কানাডায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এতে প্রবাসীদের নিজের দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত এজেন্টদের থেকে ঝুঁকির অভিযোগের কথা প্রকাশ্যে এসেছে।

তদন্তের নেতৃত্বে রয়েছেন বিচারক মারি-জোসি হগ। আগামী মাসে এই তদন্তের প্রথম প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে তিনি উল্লিখিত সম্প্রদায়ের ৪০ জন সদস্য, রাজনীতিবিদ এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য শুনেছেন।

তদন্ত কমিটির সামনে বুধবার হাজির হবেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তদন্ত কমিটির সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে, বিদেশি হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ উঠেছে তার ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন সিএসআইএস এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা হয় এই বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেননি বা তাদের (ক্ষতিগ্রস্তদের) অন্ধকারে রেখেছেন।

কানাডার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে যে এই ইস্যু মোকাবেলা করার জন্য সরকার যা করছে তা যথেষ্ট নয় এবং এক্ষেত্রে ‘ফাইভ আইস’ জোটে থাকা অন্যান্য মিত্রদেশের তুলনায় কানাডা পিছিয়ে পড়ছে।

উল্লেখ্য, ‘ফাইভ আইস’ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডাকে নিয়ে গঠিত একটি জোট যারা গোয়েন্দা বিষয়ক তথ্য আদান-প্রদান করে।

এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য এবং আংশিকভাবে গোপনীয় নথি থেকে জানা গিয়েছে এমন কিছু উপায়ের কথা যা ব্যবহার করে কানাডার ২০১৯ এবং ২০২২ সালের নির্বাচনে চীনা বা বিদেশী সরকারগুলো হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে থাকতে পারে।

যদিও এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা ইঙ্গিত দেয় যে বিদেশী হস্তক্ষেপ প্রভাব নির্বাচনি ফলাফলে পড়েছে।

সিএসআইএস অভিযোগ করেছে ২০১৯ ও ২০২২ সালের নির্বাচনে চীনা সরকার ‘গোপনীয়ভাবে এবং প্রতারণা করে’ হস্তক্ষেপ করেছিল।

ওই সংস্থা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে মূলত, 'ব্যবহারিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ দেখা গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে চেষ্টা করা হয়েছিল যারা চীনপন্থী বা সে দেশের প্রতি নিরপেক্ষ মনোভাব রাখে এমন ব্যক্তিরা যেন সমর্থন পান।'

'অনলাইন ও গণমাধ্যমের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে আমরা জানতে পেরেছি, চীনা বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক নেতা এরিন ও’টুলকে সমর্থন না করতে বলা হয়েছে।'

গত সপ্তাহে এরিন ও’টুল তদন্ত কমিটির সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। ওই সময় তিনি অভিযোগ করেছিলেন ভুল তথ্য ছড়ানোর কারণে তার নির্বাচনি প্রচারে প্রভাব পড়েছিল। এর ফলে ২০২১ সালের নির্বাচনে তার দল প্রায় ৯টি আসন হারিয়েছে।

এটি নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলকে প্রভাবিত না করলেও এরিন ও’টুলের বিশ্বাস এর ফলে তার নেতৃত্ব চলে যায়।

উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর লিবারল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
গোয়েন্দা সংস্থা সিএসআইএস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, কানাডার নির্বাচনে ভারত এবং পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে।

ভারতের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগে দাবি করা হয়েছে ভারত সরকারের এক ‘প্রক্সি এজেন্ট’ সমস্ত কর্মকাণ্ডকে বাস্তবায়িত করেছে। 'কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায়' ভারতপন্থী প্রার্থীদের সমর্থন করার বিষয়টিও ওই এজেন্টের কাজ ছিল।

সিএসআইয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ওই প্রক্সি এজেন্ট মনে করতেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিছু কানাডিয়ান ভোটার খালিস্তানি মুভমেন্ট বা পাকিস্তানের পক্ষে।’

এর আগে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন। খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নিজ্জার ২০২৩ সালের জুন মাসে কানাডায় নিহত হন। তবে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে ভারত।

হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও। সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা সীমিত ছিল এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল ‘বিশ্বে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব হ্রাস করা’।

তদন্ত কমিটির সামনে পেশ করা বিবৃতি অনুযায়ী, সিএসআইএস এবং অন্যান্য কর্মকর্তা এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি। এমন কী যে নেতাদের ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল তাদেরও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়নি।

এরিন ও’টুল জানিয়েছেন ২০২১ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাথালি ড্রুয়েন ওই সময় নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ পর্যালোচনাকারী প্যানেলের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন।

তার পাল্টা দাবি, কনজারভেটিভ পার্টির বিরুদ্ধে চীনের কার্যকলাপের অভিযোগ প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ সে সময় ছিল না।

প্যানেলের কোনো হস্তক্ষেপে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়বে এমন ঝুঁকি ছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

চীনের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
সিএসআইএ-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে চীন থেকে অজ্ঞাত এক প্রার্থীর কর্মীকে প্রায় আড়াই লাখ কানাডিয়ান ডলার (১ লাখ ৮৪ হাজার মার্কিন ডলার) দেয়া হয়। এছাড়া হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্যে অন্যদেরও অর্থ দেয়া হয়।

ওই গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ লিবারল পার্টির প্রার্থী হান ডংকে সাহায্য করার জন্য ২০১৯ সালে একটি চার্টার্ড বাসে চীনের একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনা হয়েছিল। অভিযোগ, হান ডং যাতে তিনি তার দলের তরফ থেকে প্রার্থী হতে পারেন সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই পদক্ষেপ।

সিএসআইএস দাবি করেছে, ওই শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়া হলেছিল যে ‘হান ডংকে সমর্থন না করলে তাদের স্টুডেন্ট ভিসায় সমস্যা হতে পারে এবং এর ফল ভোগ করতে হতে পারে চীনে বসবাসকারী তাদের পরিবারকে।’

হান ডং এখন একজন নির্দল নেতা। তিনি তার বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনি চীনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং নির্বাচনি প্রচারের সময় তাদের লিবারল পার্টির সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন বটে তবে এই ঘটনায় কোনো ষড়যন্ত্রের কথা অস্বীকার করছেন তিনি।

তিনি জানিয়েছেন, কানাডায় পাঠরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা লিবারল পার্টির মনোনয়নে ভোট দিতে পারেন, যদি তারা ওই নির্বাচনী এলাকায় বসবাস করেন এবং সে-সংক্রান্ত প্রমাণ থাকে তাদের কাছে।
সূত্র ; বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement