৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি : কোন পথে বাইডেন-ট্রাম্প

বাইডেন-ট্রাম্প - ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীরা হলেন ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে একেবারেই ভিন্ন মত পোষণ করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের প্রত্যেকের অবস্থান কোথায় তার একটি সার-সংক্ষেপ।

রাশিয়া-ইউক্রেন

রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাইডেন যখন ইউক্রেনকে সামরিক ও মানবিক সহায়তা পাঠানো অনুমোদন করেন তখন তিনি সতর্ক করেছেন যে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জয় কখনো হতে দিবে না। বাইডেন প্রশাসন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে এ পর্যন্ত কিছু রুশ এবং রুশ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ইউক্রেনের জন্য ৭৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পাঠিয়েছে।

বাইডেন ২০২৪ সালের ৭ মার্চ বলেন, 'রাশিয়ার পুতিন সারা ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছেন এবং সারা ইউরোপ এবং এর বাইরেও বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করছেন। এই ঘরে কেউ যদি মনে করেন যে পুতিন ইউক্রেনেই থামবেন তাহলে আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি যে তিনি তা করবেন না। তবে ইউক্রেন পুতিনকে থামাতে পারবে যদি আমরা ইউক্রেনের পাশে থাকি এবং তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করি। ইউক্রেন কেবল সেটাই চায়। তারা আমেরিকান সৈন্য চাইছে না।'

ট্রাম্প বলেছেন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তাদের অংশের যে প্রাপ্য সহায়তা ইউক্রেনকে দেয়ার কথা তা তারা দিচ্ছে না। ট্রাম্প দাবি করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি সহায়তা পাঠিয়েছে। ট্রাম্প ফেব্রুয়ারি মাসে এক সমাবেশে বলেন, তিনি ন্যাটোর এক সদস্যেকে বলেছেন, ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে তাদের ব্যয় পূরণ না করলে তিনি রাশিয়াকে উৎসাহিত করবেন যে কোনো সদস্যকে যা খুশি তাই করতে। তিনি ন্যাটো সদস্যের নাম প্রকাশ করেননি। ২০২৩ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ারে এক বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছিলেন, 'প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার ভয়াবহ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে।'

ট্রাম্পের শাসনকালে রাশিয়ার সাথে গোপন সহযোগিতা-সম্পর্কিত একাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি এবং ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি পরিষদ তৎকালীন সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে ক্ষতি করতে পারে- এমন তথ্যের বিনিময়ে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবে এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ট্রাম্প অবশ্য ওইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে অভিশংসন মামলায় তিনি রেহাই পান।

চীন

বাইডেন ২০২৪ সালের ৭ মার্চ বলেছিলেন, 'বিশ্বের সবচেয়ে সেরা অর্থনীতি হচ্ছে আমাদের। এবং আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমাদের জিডিপি বেড়েছে, এক দশকের মধ্যে আমাদের সাথে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে এবং আমরা চীনের অন্যায্য অর্থনৈতিক অনুশীলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। আমরা তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে রয়েছি। আমি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে আমাদের অংশীদারিত্ব ও জোটকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। আমি নিশ্চিত করেছি, চীনে যেন আমেরিকার সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করতে পারে। ওইসব (প্রযুক্তির ক্ষেত্রে) বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। স্পষ্ট ভাষায় বলছি, চীন সম্পর্কে বিস্তর গুরুতর কথাবার্তা ছাড়া আমার পূর্বসূরি এর কোনোটাই করার কথা ভাবেনি। সংঘাত নয় আমি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চাই। আর একবিংশ শতাব্দীতে চীন বা অন্য কারো বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছি।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হুমকিকে এই প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ বলে নিন্দা জানান। তিনি বলেছিলেন যে চীন কোভিড-১৯ মহামারীর জন্য দায়ী এবং হংকংয়ে 'এক দেশ, দুই রাষ্ট্র' নীতি বন্ধের জন্য চীনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিধি আরোপ করেছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে দেয়া এক ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে একটি অবাধ ও গঠনমূলক সম্পর্ক চায়, তবে সেই সম্পর্ক অর্জনের জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থকে কঠোরভাবে রক্ষা করা প্রয়োজন।'

নির্বাচনী প্রচারণার ওয়েবসাইটে ট্রাম্প বলেন, 'আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য জ্বালানি, প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, কৃষিজমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, চিকিৎসা সরবরাহ এবং অন্যান্য কৌশলগত জাতীয় সম্পদসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে চীনের মালিকানার ওপর নতুন করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের এইসব গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে চীনের (তৈরি) জিনিষপত্র ক্রয় বন্ধ করা উচিত। এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ওইসব শিল্পে (বা শিল্পখাতে) বর্তমানে চীনের যেকোনো বিনিয়োগ বা হোল্ডিং বিক্রি করতে তাদেরকে বাধ্য করার প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।'

ইসরাইল-ফিলিস্তিনি

বাইডেন বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে ইসরাইলের, তবে ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণকে হত্যা করার বিরুদ্ধে ইসরাইলকে সতর্ক করেছেন। মার্চ মাসে বাইডেন গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য অদূরে একটি বন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন

বাইডেন ২০২৪ সালের ৯ মার্চ নিউইয়র্কে বলেন, আমি কখনো ইসরাইলকে ছেড়ে যাব না। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে কোনো রেড লাইন বা লাল সীমারেখা চলে না। আমি যদি সমস্ত অস্ত্র দেয়া বন্ধ করি তা হলে তাদের কাছে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের (প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) আয়রন ডোম থাকবে না। তাদের নেই- তবে সেখানে লাল রেখা রয়েছে, যদি সে তা অতিক্রম করে এবং তারা অব্যাহত রাখে...তাহলে হামাসের সৃষ্ট ভয়ঙ্কর বেদনা মোকাবেলার জন্য যেখানে অন্য উপায় রয়েছে সেখানে আপনি আরও ৩০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করতে পারেন না ।

২০২০ সালে ট্রাম্প একটি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন যেখানে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ওই পরিকল্পনায় ইসরাইলকে একটি ঐক্যবদ্ধ জেরুজালেম সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ দেবে এবং পশ্চিম তীরে তাদের বসতি বজায় থাকবে।

২০২৪ সালের ২৫ মার্চ ট্রাম্প ‘ইসরাইল হায়োম’ সংবাদপত্রকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বর্তমান সংঘাত সম্পর্কে বলেন, '৭ অক্টোবর আমি যা দেখেছি তা আমার দেখা সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাগুলোর একটি। আপনাদের যুদ্ধ অবশ্যই শেষ করতে হবে। এটা শেষ করার জন্য আপনাকে পরিসমাপ্তি টানতে হবে। এবং আমি নিশ্চিত যে আপনি তা করবেন। এবং আমাদের শান্তি অর্জন করতে হবে; আমরা একে চলতে দিতে পারি না। এবং আমি বলব, ইসরাইলকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, কারণ তারা বিশ্বের কাছ থেকে অনেক কিছু হারাচ্ছে, আপনারা প্রচুর সমর্থন হারাচ্ছেন, আপনাদের এটা শেষ করতে হবে, আপনাদের এ কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এবং আপনাদের শান্তি (প্রক্রিয়ায়) যেতে হবে, ইসরাইলকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে।'

ইরান

বাইডেন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা জেসিপিওএ-কে 'মৃত' ঘোষণা করার আগে ওবামা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তিটি পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। গত বছর বাইডেন প্রশাসন ইরানের কয়েক বিলিয়ন ডলারের জব্দ সম্পদ মুক্ত করার বিনিময়ে পাঁচ আমেরিকান পণবন্দীকে মুক্তির ব্যবস্থা করে।

২০২৪ সালের ৭ মার্চ ওয়াশিংটনে বাইডেন বলেন, 'মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মানে হচ্ছে ইরানের হুমকি মোকাবেলা করা। এ কারণে আমি লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল এবং নৌ চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষায় এক ডজনেরও বেশি দেশকে নিয়ে একটি জোট গঠন করেছি। ওই অঞ্চলে হাউছিদের সক্ষমতা কমাতে এবং আমেরিকান বাহিনীকে রক্ষার জন্য আমি অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছি। কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে আমাদের জনগণ ও সামরিক সদস্যদের সুরক্ষায় আরও পদক্ষেপ নিতে আমি দ্বিধা করব না।'

ট্রাম্পের ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রকে জেসিপিওএ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ছিল তার সবচেয়ে গর্বিত অর্জনের মধ্যে একটি। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র সশস্ত্র শাখা কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার জন্য অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং ওই হামলায় সোলাইমানি নিহত হন।

উত্তর কোরিয়া

বাইডেন প্রশাসন বারবার বলে এসেছে যে তারা উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনা করতে ইচ্ছুক, তবে তা হতে হবে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়া। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনকে আলোচনায় উৎসাহিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের অর্থনৈতিক সহায়তামূলক প্রণোদণার প্রস্তাব দেয়া হয়নি। বাইডেন আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একটি নতুন পারমাণবিক প্রতিরোধ চুক্তি ঘোষণা করেছেন, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রকে দক্ষিণ কোরিয়া তার বন্দরগুলোতে সাবমেরিন রাখার অনুমতি দেবে।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে 'পূর্নাঙ্গ, যাচাইযোগ্য এবং অপরিবর্তনশীল পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণের' দিকে এগিয়ে নিয়ে যান তবে শেষ পর্যন্ত একাধিক বৈঠকের পরে জং-উনের সাথে একটি ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তার ব্যক্তিগত কূটনীতির ফলে এই দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি কিন্তু হয়নি।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা

 


আরো সংবাদ



premium cement