তালেবানের শাসনে খুশি গোলিজুমার পরিবার
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৫৪
কাদা ও মাটির তৈরি বাড়ির ভেতরটি ঠাণ্ডা, শান্ত ও ঝকঝকে পরিষ্কার। শামসুল্লাহ অতিথিদের তার বাড়ির বৈঠকখানায় বসাচ্ছিলেন। তার ছোট বাচ্চা ছেলেটি তার পা আঁকড়ে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে ছিল।
বৈঠকখানার মেঝের পুরোটা জুড়ে কার্পেট। তার ওপর চার দেয়ালে ঠেস দেয়া মোটা মোটা সব কুশন। একেকটি কম করে হলেও দুই ফুট করে মোটা। ঘরের এক কোনে ছোট একটি কেবিনেটের ভেতর ছয়-সাতটি নানা রঙের ছোট কাচের বোতল সাজানো।
গরিব একটি পরিবার। একসময় জিনিসপত্র, সম্পদ যা ছিল তা গত ২০ বছরের যুদ্ধে হয় লুট হয়েছে, না হয় ধ্বংস হয়েছে।
বাইরে কড়া রোদ এবং ধুলা থেকে ঘরের ভেতর ঢুকে যেন একটা শান্তি মিলল। বাড়িটি উঁচু মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। আশপাশের সব বাড়ির চেহারা একই রকম।
হেলমান্দ প্রদেশের মারজাহ নামে এই গ্রামটি গত ২০ বছরে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
বাড়ির উঠানের একদিকে পাঁজা করে তুলা রাখা রয়েছে। বোঝাই যায়, পাশের ক্ষেত থেকে সদ্য তুলে আনা।
শামসুল্লাহ বাড়ির ভেতর থেকে তার মা গোলিজুমাকে নিয়ে এলেন। জানালেন মায়ের বয়স ৬৫। লম্বা চাদর দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। শুধু চোখের জায়গায় ছোট একটি অংশ ফাঁকা যাতে তিনি দেখতে পারেন। চাদরের ওই ছোট ফাঁকা অংশটি দিয়ে ওই নারীর চোখ এবং নাকের একটি অংশ আমি হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাচ্ছিলাম।
কিন্তু আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা গোলিজুমা যখন তার জীবনের করুণ কাহিনী এবং কিভাবে গত ২০ বছরের যুদ্ধে তিনি তার চার ছেলেকে হারিয়েছেন তা বলতে শুরু করলেন তার কণ্ঠ ছিল জড়তাহীন, শক্ত। তার পাঁচ ছেলের মধ্যে শুধু সবচেয়ে ছোটটি বেঁচে আছেন। গোলিজুমা বললেন, শামসুল্লার বয়স ২৪। চেহারা দেখে অবশ্য মনে হয়, বয়স তার চেয়ে ১০ বছর বেশি।
গোলিজুমার সবচেয়ে বড় ছেলে জিয়া-উল হক মারা যায় ১১ বছর আগে। তিনি তালেবানের যোদ্ধা ছিলেন। 'আমার ছেলে তালেবানে যোগ দিয়েছিল কারণ সে মনে করত, আমেরিকানরা আফগানিস্তান ও ইসলামকে ধ্বংস করতে চায়,' বললেন ওই আফগান নারী।
তার পরের তিন ছেলে মারা যায় ২০১৪ সালে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। মেঝ ছেলে কুদরাতুল্লাহ মারা যায় এক বিমান হামলায়। তার পরের দুই ভাই হায়াতোল্লাহ এবং আমিনুল্লাহকে পুলিশ বাড়ি থেকে আটক করে নিয়ে যায়। শামসুল্লাহ জানান, তার ঐ দুই ভাইকে জোর করে আফগান সেনাবাহিনীতে নাম লেখানো হয়েছিল। লড়াইয়ে তাদের মৃত্যু হতে সময় লাগেনি।
শামসুল্লাহ বললেন পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্যই হয়ত আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। 'আপনি কখনো এক হাতে পাঁচটি তরমুজ ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন? আমার এখন সেই দশা, আমাকে সেটাই করতে হচ্ছে,' শামসুল্লাহ আমাকে বললেন।
তার দায়িত্বগুলোর অন্যতম সবচেয়ে বড় ভাই তালেবান যোদ্ধা জিয়ার বিধবা স্ত্রীর দেখভাল। 'আমি আমার ভাইদের অভাব খুব অনুভব করি,' বললেন শামসুল্লাহ।
'আমার সবচেয়ে বড় ভাই যখন মারা যায় তার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন আমার মেজ ভাই। যখন ঐ ভাই মারা যায় তখন পরের ভাইটি তাকে বিয়ে করেন। যখন আমার সেজ সেই ভাইটিও মারা যায় তখন তার পরের ভাই আমার বড় ভাবিকে বিয়ে করেন। সেই ভাইও যখন মারা গেল তখন তাকে বিয়ে করলাম আমি।'
ওবামার 'সার্জ' এবং মারজাহ গ্রাম
২০১০ সালে যখন প্রেসিডেন্ট ওবামা আফগানিস্তানে সেনা অভিযান জোরদার সিদ্ধান্ত নিলেন তার প্রথম ধাক্কা গিয়ে পড়ে হেলমান্দের এই মারজাহ এলাকায়।
আমেরিকানদের লক্ষ্য ছিল চরম চাপ তৈরি করে তালেবানকে আফগানিস্তান থেকে একবারে উৎখাত করে দেয়া, যাতে কাবুলে সরকারের ওপর আর কোনো হুমকি না থাকে।
ওই সময় আমেরিকান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া একটি প্রেস রিলিজের ভাষা ছিল এরকম - 'তালেবানকে উৎখাত করতে পারলেই আফগানিস্তানের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে : ভালো স্কুল, ভালো হাসপাতাল এবং জমজমাট বাজার।'
মারজায় তালেবান আদৌ তখন ছিল কি ছিল না তার তোয়াক্কা না করে বিদেশী সৈন্যরা যেভাবে বোমা আর গোলাবর্ষণ শুরু করে তাতে এলাকার তুলা আর আফিমের উর্বর ক্ষেত স্থানীয় মানুষগুলোর দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
তীব্র ওই সেনা অভিযান শুরুর তিন মাসের মাথায় আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা কম্যান্ডার জেনারেল স্টেনলি ম্যাক-ক্রিস্টাল মারজাহ এলাকাটিকে 'পাকস্থলীর একটি আলসার' বা ঘায়ের সাথে তুলনা করেন যেটি থেকে সারাক্ষণ রক্তক্ষরণ হয়। তবে হেলমান্দের ওই এলাকায় সেই অভিযান শেষ করার পরের ১০ বছরও সেখানে কিছুদিন পরপরই পশ্চিমা সৈন্যদের লড়াই করতে হয়েছে।
'তারা আমাদের স্বামীদের, ভাইদের, ছেলেদের হত্যা করেছে'
গত ২০ বছরে যেসব পশ্চিমা নেতা বলে গেছেন যে তারা আফগানিস্তানের ভালো চান তাদের ঘৃণা করেন গোলিজুমা।
'আমি জানি না তারা কী ভাবতেন, কিন্তু তারা এই দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন,' বলেন ওই নারী।
গত ২০ বছরে তৈরি নানা সুযোগ-অধিকার এখন হুমকিতে পড়ে গেছে বলে অনেক আফগান নারীর যে আতঙ্ক- তা নিয়ে তার ভাবনা কি? আমার এই প্রশ্নকে তিনি কোনো গুরুত্বই দিলেন না।
গোলিজুমা বরঞ্চ বললেন, 'তারা (পশ্চিমারা ) যখন এখানে ছিল অসংখ্য মানুষ চরম দুর্ভোগ সহ্য করেছে। তারা আমাদের স্বামীদের, ভাইদের, আমাদের ছেলেদের হত্যা করেছে।'
তিনি বলেন, 'আমি তালেবানকে পছন্দ করি কারণ তারা ইসলামকে সম্মান করে। আমার মত নারীরা কাবুলের নারীদের মতো নয়।' তার কথা তারা এখন অনেক স্বস্তিতে যে 'লড়াই শেষ হয়েছে।'
একটি প্রশ্ন এবং সন্দেহ অবশ্য ছিল যে মারজার ওই নারী কি সত্যিই মন খুলে কথা বলছেন। কারণ, তালেবানের মিডিয়া অফিসের শর্ত ছিল যে হেলমান্দে অবস্থানের সময় বিবিসি টিমের সাথে সবসময় সশস্ত্র একজন তালেবান সৈন্য থাকবে এবং মিডিয়া অফিসের অনুমোদিত একজন অনুবাদক থাকবে। ওই দুজন না থাকলে অনেক মানুষ হয়তো তালেবানকে নিয়ে তাদের মনের কথা খুলে বলার সাহস পেত। কিন্তু হেলমান্দের একটি গ্রামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর সামরিক তৎপরতা নিয়ে যে ক্ষোভ, নিজের চার সন্তানকে হারানো নিয়ে যে ক্রোধ গোলিজুমা প্রকাশ করেছেন তার সততা নিয়ে আমার মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না।
সুযোগ-সুবিধা সবই ছিল শহরে
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পরপরই আল কায়েদাকে ধ্বংস করতে এবং তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তালেবানকে শায়েস্তা করতে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা কটি মিত্র দেশ আফগানিস্তানে হামলা চালায়। কিন্তু তারপর যা ঘটেছে তা বোঝা এবং তার পক্ষে যুক্তি খাড়া করা খুবই জটিল একটি বিষয়।
আফগানদের জীবনের মান উন্নত করার যুক্তিতে চালিয়ে যাওয়া ওই যুদ্ধ এমন রূপ নেয় যাতে জয়ী হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের মতো উন্নয়নও বন্দুক দিয়ে অর্জন সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধে পশ্চিমারা বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে। শহুরে আফগানদের একটি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা পেয়েছে এবং তাদের চিন্তা-চেতনা-জ্ঞানের প্রসার হয়েছে। কিন্তু সেসব সুযোগ সুবিধা গোলিজুমার পরিবারের মতো গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের কাছে কখনই পৌঁছেনি।
তালেবান যখন ১৯৯৬ সালে প্রথম আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে, তারা তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা জোর করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিংহভাগ আফগান এখন নাইন-ইলেভেনের আগে তাদের দেশের ওই বাস্তবতা চোখে দেখেনি।
লশকর গা শহরে তরুণ তালেবান যোদ্ধারা বিবিসির ক্যামেরা দেখে তাদের মোবাইল ফোন পকেট থেকে বরে করে আমাদের ছবি তুলেছে। বিদেশীদের সাথে সেলফি তুলেছে তারা। অথচ ১৯৯৬ তে ক্ষমতা নিয়ে তালেবান ছবি তোলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।
আফগানিস্তানে মোবাইল ডেটা সস্তা। তালেবানের যে যোদ্ধাটি সর্বক্ষণ আমাদের সাথে ছিল সে মোবাইল ফোনে বিবিসি পশতু বিভাগের অনুষ্ঠান দেখত।
ইন্টারনেটের কল্যাণে তালেবানের নতুন প্রজন্মের কাছেও এখন বাকি বিশ্ব আর অজানা নয়। তাদের বড় হওয়া, তাদের অভিজ্ঞতা নব্বইয়ের দশকের তালেবানের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ আফগান তো দূরে থাক তালেবান নেতারা কি এখন তাদের নিজেদের যোদ্ধাদের জন্যও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারবেন? ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করতে পারবেন? এ দফায় জোর করে তেমন কিছু করতে যাওয়া তালেবানের জন্য খুবই কঠিন হবে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা