২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রমজানে খাদ্য অপচয় যেন না হয়

রমজানে খাদ্য অপচয় যেন না হয় - ফাইল ছবি

রমজান মাসে মুসলমানদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়। মানুষ ভোররাতের সাহরির সময় পুষ্টিসম্মত ভালো খাবার ও ইফতারের সময় নানা পদের খাবার তৈরি করে। তাই এই সময়ে খাওয়ার ধরনগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করে। প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় সময় বেশি খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন হয়। তাই সচেতনতা ও পরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হয়; সংযম এবং কৃচ্ছ্রতার ওপর জোর দেয়া সত্ত্বেও, খাদ্য অপচয় ও বর্জ্য সম্পর্কে সচেতনতা কম থাকে। কুরআনে বলা হয়েছে : আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও, এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। (সূরা বনি ইসরাইল-২৬) তথাপি অপচয় চলমান রয়েছে।

আরব দেশগুলোতে, রমজানের সময় খাদ্য অপচয় একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। রোজার কারণে স্বাভাবিকভাবে সন্ধ্যায় ইফতারের খাবারটি কেন্দ্রীয় আয়োজনে পরিণত হয়। এক সাথে একই সময়ে পরিবারের সবাই ঘটা করে জড়ো হয়ে ইফতার করতে আসেন, ফলে প্রচুর খাবার প্রস্তুত হয়, বড় আয়োজন হয়। উদারতার চেতনা হোস্টকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার প্রস্তুত করতে উৎসাহ জোগায়, যার ফলে অতিরিক্ত খাবার হয়। অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে, রমজান মাসে খাবার ভাগ করে নেয়া একটি লালিত ঐতিহ্য। লোকেরা প্রায়শই প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব এবং এমনকি অপরিচিত ব্যক্তিদেরও তাদের ইফতারের খাবারে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায় এবং খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে অতিরিক্ত আয়োজন করে। রেস্টুরেন্ট, হোটেল এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলো বিস্তৃত ইফতার-বুফের আয়োজন করে। এই ইভেন্টগুলোতে প্রায়শই খাবার, মিষ্টান্ন এবং পানীয় থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে, পরিবেশন করা সব খাবার খাওয়া হয় না, অপচয় স্ফীত হয়।

বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জন্য পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের গুরুত্ব অপরিসীম। ইফতার সংস্কৃতি বা অভ্যাস মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, সহানুভূতি এবং উদারতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। স্বাস্থ্যসম্মত সতেজ খাবার, গোশত-পরটা, খেজুর-আনার, সালাদ ও ফ্রাই খাবার, শরবত ও মিষ্টিজাতীয় খাবার অবশ্যই সব দস্তরখানায় থাকে এবং অবশ্যই এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা।

জিসিসি দেশগুলোতে, রমজানের সময় প্রস্তুত করা খাবারের প্রায় ৫০ শতাংশ বিনষ্ট হয়। দুবাইতে, রমজানের সময় গৃহস্থালি বর্জ্যরে ৫৫ শতাংশ বেশি খাদ্যদ্রব্য। রমজানে সৌদি আরবে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন খাদ্য অপচয় হয়। বাহরাইন প্রতিদিন ৪০০ টনেরও বেশি খাদ্য অপচয় হয়।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ২৭টি দেশে খাবারের সঙ্কট দেখা দেবে বা সঙ্কট শুরু হয়েছে মর্মে সতর্ক করেছে। মালয়েশিয়ানদের একটি বড় বদ-অভ্যাস খাবারের প্লেটে খাবার রেখে আহারপর্ব শেষ করা। মালয়েশিয়ায় খাবারের দাম সহনীয় পর্যায়ে তাই কোনো চিন্তাভাবনা না করেই বেশি খাবার নিয়ে তা প্লেটেই ফেলে রাখা হয়। প্রাপ্ত একটি তথ্যে দেখা গেছে : ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার খাদ্য আমদানি ৪৩ বিলিয়ন রিংগিত থেকে বেড়ে ৫৪ মিলিয়ন রিংগিতে দাঁড়িয়েছে। মালয়েশিয়া সাধারণত চাল, গরুর গোশত, খাসি, আম, বাঁধাকপি, মরিচ ও নারিকেল আমদানি করে, এসব মালয়েশিয়ানদের প্রিয় ও প্রধান খাবার।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জাতিসঙ্ঘের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতি বছর মানুষ প্রায় ১০০ কোটি টন খাবার অপচয় করে। আরো উল্লেখ করা হয়, বিশ্বজুড়ে বাড়িতে একজন ব্যক্তির বছরে খাবার অপচয়ের পরিমাণ গড়ে ৭৪ কেজি। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে অপচয় করা হয় প্রতি সপ্তাহে আট বেলার খাবার। মোট খাবার অপচয়ের ১৭ শতাংশ হয় রেস্তোরাঁ ও দোকানে। কিছু খাবার নষ্ট হয় কারখানা ও সাপ্লাই চেইনে, অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ খাওয়াই হয় না। অর্থাৎ কয়েক শত কোটি অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত মানুযের খাবার নষ্ট করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় রমজান মাসে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার টন খাবার ফেলে দেয়া হয়। তার হিসাবে, প্রতি বছর রমজান মাসে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার টন খাদ্য সরাসরি ডাস্টবিনে চলে যায়। এই পরিমাণ খাদ্য ১৮০ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানো যায়, যা দেশটির দুই কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার ছয়গুণ।

রমজান এবং এর বাইরেও খাদ্য অপচয় বা বর্জ্যরে উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নৈতিক বিবেচনাও বড় বিষয়। অন্যরা ক্ষুধার্ত থাকার সময় খাবারের অপচয় নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। ইসলাম সহমর্মিতা এবং খাবার ভাগ করে নেয়ার ওপর যেখানে জোর দেয়। সেই সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে সরে আসা হয়। রমজানে বাড়তি খাবার তৈরি করা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সচেতনতার পরিপন্থী। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’

খাদ্য অপচয় হ্রাস করা কেবল পরিবেশের জন্যই নয়, মানিব্যাগের জন্যও উপকারী। খাদ্য অপচয় হ্রাস করার জন্য অনেক পন্থা অবলম্বন করা যায়। যেমন- স্মার্ট বাজার মানে যা প্রয়োজন কেবল তাই কিনুন; মুদিদোকানে ঘন ঘন যাওয়া পরিহার করুন, আরো কেনার আগে বাড়িতে বিদ্যমান খাবার ব্যবহার করুন, খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে শিখুন, ফল-সবজি সংরক্ষণের নিয়ম শিখুন, খাবারের পরিকল্পনা করুন ও বাহুল্য বর্জন করুন, নৈশভোজের অতিরিক্ত খাবার পুনঃব্যবহার করতে শিখুন বা উদ্বৃত্ত খাবার দান করুন, ফুড ব্যাংক, মাদরাসা, এতিমখানা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ, আশ্রয়কেন্দ্রে দান করুন। মুসলিম দেশগুলোতে খাদ্য অপচয় মোকাবেলার জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন- সাংস্কৃতিক সচেতনতা, নীতিগত হস্তক্ষেপ এবং স্বতন্ত্র দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার।

প্রতি পরিবার বা প্রতি খাবারের দোকানে কতটুকু খাবার পরিত্যক্ত হয় সেটি ‘ফুড ডায়েরি অ্যাপ’ ব্যবহার করে মনিটর করা যায় এবং সতর্ক হওয়া যায়। মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে ২৭৯ জন অংশগ্রহণকারীকে অ্যাপের মাধ্যমে সার্ভে করার ব্যবস্থা করা হয়। এতে ২৭.৩ শতাংশ বিশ্বাস করে যে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে ফুড ডায়েরির কারণে। ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী খাবার অপচয় রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। মালয়েশিয়ার সচেতন জনগণ মনে করেন, খাবার অপচয়ের জন্য পাবলিক প্লেসে জরিমানার বিধান চালু করা উচিত।
জরিমানা পদ্ধতি অনেক দেশে অপচয় রোধে সফলতা এনেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় আইন করা হয়েছে এবং ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার খাবার পুনঃব্যবহারের জন্য বিশেষ ব্যাগে রাখার পদ্ধতিও চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত খাবার উৎপাদন হয়, তারও একটি বড় অংশ ভাগাড়ে যায়। জাতিসঙ্ঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউনেপ ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ছয় লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশি।

তাই, সহমর্মিতার এ মাসে যেন বৈষম্য না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা দরকার। আমাদের দেশে অনেক মানুষ নানারকম খাবারের পসরা সাজিয়ে ইফতার করেন; অথচ একই সময়ে আরেক শ্রেণীর মানুষ খুব সামান্য কিছু দিয়ে ইফতার করেন। আনন্দের বিষয় হলো বাংলাদেশেও কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এদের জন্য ইফতার প্যাকেট প্রদানের ব্যবস্থা করেছ্।ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিজিটাল ইফতার ভেন্ডিং মেশিন ‘আমার ইফতার’ বসানো হয়েছে তবে তা অপ্রতুল, অনেক সময় চোখে পড়ে না। বড় বড় হোটেলের ইফতারের পরও যেসব খাবার বাঁচে সেগুলো প্রসেস করে ভেন্ডিং মেশিনে দিলে অনেক গরিব উপকার পাবে। অপচয় থেকে বাঁচার জন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement

সকল