২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সামাজিক দায়বদ্ধতার শর্ত

সামাজিক দায়বদ্ধতার শর্ত - নয়া দিগন্ত

সমাজ ও অর্থনীতি-দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক সুপ্রাচীন, তবে সময়ের বিবর্তনে সম্পর্কের মধ্যে মতান্তর ঘটেছে। হতেই পারে। হওয়া স্বাভাবিক। কেননা সমাজ পরিবর্তনশীল নিজস্ব গতিতে, অর্থনীতি সমাজের সেই গতিশীলতার নিয়ামক। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায়, যখন অর্থনীতির কাছে সমাজ পরিবর্তনের প্রেসক্রিপশন প্রত্যাশা করা হয়, যখন আশা করা হয়, সমাজ বিনির্মাণে আদর্শ ও দর্শন সরবরাহ করতে অর্থনীতির করণীয় কী? আবার অর্থনীতি যদি সমাজের সমৃদ্ধি সাধনে লাগসই ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারে; তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বঞ্চনা বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। তা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার বিষয়, সমাজের কী কোনো দায় দায়িত্ব নেই। যদি প্রশ্ন উত্থাপন না করতে পারল সমাজ ও অর্থনীতির গতিধারা নিয়ে, সমাজের গন্তব্য নিয়ে, সমাজের সার্থকতা নিয়ে তাহলে তো সমাজের উন্নতির প্রচেষ্টা ব্যর্থতার বিবরে চলে যাবে। সমাজ সমাজের মতো কঠিন কর্কশ পথে এগোতে থাকবে আর সুবোধ বালকের মতো অর্থনীতি তাতে সর্বনাশের পথ রচনা করে চলবে, পথ সুগম হবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে চলাচলের। অর্থনীতির সনাতন নীতি ও নিয়মকানুন বেকুব বনে যায় যে সমাজে, সেখানে উন্নতির কোনো কার্যকর গাইডলাইন বা রোডম্যাপ এখন কেন কস্মিনকালেও কেউ দিতে পারেনি, পারবে বলে মনে হয় না। কখনো-সখনো এ ব্যাপারে কথাবার্তা যে ওঠেনি তা নয়, কিন্তু কার্যকরণগত কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যার অবর্তমানে আলোচনাটা যেন সেভাবে রয়ে গেছে।

নিঃসন্দেহে সমাজ আগে, অর্থনীতি পরে। সমাজ একটা বড় ব্যাপার অর্থনীতি সেখানে নিয়ামক ভূমিকা পালনকারী অনুগামী একটা শরিক মাত্র। অর্থনীতিকে আমলে না আনলে সমাজের কিছু একটা যায় আসে না, কিন্তু অর্থনীতি সমাজকে উপেক্ষা করতে পারে না। সমাজ হচ্ছে অর্থনীতির ক্যানভাস, সমাজ ছাড়া অর্থনীতির চলে না, সমাজে অর্থনীতির ভূমিকা আছে।

সমাজ নেই তো শুধু অর্থনীতি কেন অনেক কিছু নেই। তবে অর্থনীতি সমাজকে নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করে বলে সমাজ তার অস্তিত্ব, গতিধারা এমনকি মিশন ও ভিশন নির্মাণে অর্থনীতির পথ চেয়ে থাকে। সমাজ এগুচ্ছে না পেছাচ্ছে তা অর্থনীতির চেয়ে আর কে ভালো বলতে পারে? সমাজ সীমাহীন তীরহারা নদীর মতো চলার পথে অর্থনীতি তার তীর বেঁধে দেয়, অর্থনীতি তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় নির্দেশ করে, গতিশীল হতে সলাপরামর্শ প্রেরণা দেয়। সমাজ যেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, সার্থকতা ফিরে পায় অর্থনীতির গতিশীলতায়। সাহিত্য সমাজকে আর্কাইভে ভরে রাখে, তাকে শ্রেণীবিন্যাস থেকে শুরু করে পর্যায় পর্ব পরিচিতি পর্যন্ত নির্মাণ নির্ধারণের কাজও করে। সাহিত্য না থাকলে সমাজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু হতে পারত না, কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকত না। চর্যাপদের মধ্যে অঙ্কিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার সমাজচিত্র যেমন সমকালীন জীবনযাত্রার ইতিহাসের সংরক্ষক। সমাজ চলে সবাইকে নিয়ে, অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা আদর্শ ও দর্শন অবলম্বন করে। এ সবের ব্যত্যয় এর ব্যারোমিটার মনিটর করে অর্থনীতি। সমাজের গতি যুগধর্ম অবলম্বন করে। পরিবেশ পরিস্থিতি যুগধর্মের নিশান বরদার। পরিবেশ আপনা আপনি নির্মিত হয় না। পিছনে কাজ করে নানান কার্যকারণ। সেই কার্যকারণ সৃজিত হয় প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাত্রা ও মর্জির দ্বারা এবং প্রকৃতির আচরণের বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সূত্রে। মানুষ প্রকৃতির কোলে প্রতিপালিত হয়, প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মানুষ জীবন যাপন শুধু করে না; সেই জীবনের নানা প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে, সহায় সম্পদ সৌধ নির্মাণ করে, রুচি অভিরুচির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এভাবে প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়ায় বেড়ে ওঠে মানব জীবনের নানান পর্ব। পার্ল এস বাকের গুড আর্থে আমরা জীবন আর প্রকৃতির নিরন্তর সংগ্রাম সৌহার্দ্যরে যোজনা দেখি। প্রায় শতবর্ষের পরিক্রমার ক্যানভাসে আনন্দ বেদনার কাব্য রচিত হয় চীনা সমাজে তিন পুরুষের সংগ্রাম আর সন্ধির আয়নায় দেখা অসংখ্য ঘটনা ও এর আকর্ষণ বিকর্ষণের বর্ণিল অবয়বে। এখানে নিরন্তর রূপান্তর প্রত্যক্ষ করি উপলব্ধির, মূল্যবোধের, আচার আচরণের।

যুগধর্মের প্রতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন আচরণে নিষ্ঠ হয়েছে এর বিভিন্ন চরিত্র। সমকালীন সমাজের রূপান্তর আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয় চরিত্রনিচয়ের আবেগ অনুভূতি আর উক্তি ও উপলব্ধির সালতামামিতে। অর্থনীতির প্রযোজনায় নগরায়ণ ও শিল্পবিপ্লব এসেছে, গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে অনুপ্রবেশের অন্তরালে স্মৃতিভাণ্ডারে যে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছে, চেতনার কার্নিশে জল পড়ে পাতা নড়ের যে অনুরণন সৃষ্টি হয়েছে; তার মধ্যে পাঠক উপলব্ধি করেন নস্টালজিক নান্দনিকতার। শরৎচন্দ্রের দেবদাসে তাল সোনাপুর গ্রামে পার্বতী দেবদাসের আবাল্য কৈশোর ও বয়োসন্ধির আবেগ উৎকণ্ঠাকে শহুরে চুনিলাল চন্দ্রমুখীর দগ্ধ জীবনবোধের সাথে কালান্তরে এক অভিনব সমান্তরাল রৈখিক চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে জীবনের সেই নিত্যতা নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন লেখক যা মানবজীবনের শাশ্বত সম্পর্কের কাব্যগাথা। তাল সোনাপুর গ্রামবাংলার হাজার গ্রামের একটি। কিন্তু দেবদাস পার্বতীর গ্রাম হিসেবে তা হয়েছে স্বনামধন্য। সাহিত্য এভাবে সমাজকে কালান্তরে পৌঁছিয়ে দেয়। নগর আর গ্রামীণ জীবনের ক্যানভাসে পরিবর্তনের প্রান্তসীমায় মানব সম্পর্কের আটপৌরে অবয়ব, আনন্দ বেদনার, অভিমান আক্ষেপের, আভিজাত্য আর আবহমান হৃদবন্ধনপ্রয়াসের ধ্রুপদ সঙ্গীত এখানে শ্রুত হয়।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ৯ ও ১০ তারিখে জার্মানিতে ‘বার্লিন ইকোনমিক ফোরাম ২০১৮’ সম্মেলনে Socially Responsible Investment Sustainability Concerns সম্পর্কে Key Note Address করতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে যে প্রবন্ধ পাঠ করি তাতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুই ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছি Socially Responsible Investment ধারণার উদ্ভব, বিকাশ ও বর্তমান অবস্থার। সামাজিক বিনিয়োগ বা ব্যবসায় এশীয় দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি, মাইক্রোক্রেডিটসহ জাকাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতার বৈশিষ্ট্যসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে তা তুলে ধরি।

মূলত এবং মুখ্যত যেকোনো বিনিয়োগ ভাবনার পেছনে অবশ্যই কল্যাণ ধর্মের উপস্থিতি থাকে। তবে কল্যাণ কামনার এখতিয়ার যদি বাণিজ্য ব্যবসা কিংবা স্বার্থ চিন্তার চেয়ে পিছিয়ে পড়ে তাহলে তা আর সামাজিক দায়বদ্ধ বিনিয়োগ হয় না। উৎপাদনকারী তার পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতার ক্রয়সক্ষমতা বৃদ্ধি যেমন প্রত্যাশা করবে তেমনি বেশি ক্রেতা এ জিনিস কিনুক এ আশাও রাখতে হবে। কিন্তু ক্রেতার যদি চাহিদা না থাকে তাহলে পণ্য যত ভালো হোক তা বিক্রি হবে না। সে কারণে আধুনিক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের যুগে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বা উন্নত বিশ্ব স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশে তাদের পণ্য ও সেবা বিপণনের জন্য সে দেশের জনগণের পারচেজিং পাওয়ার প্যারেটি বা ক্রয়ক্ষমতা অনুপাত তথা তাদের জীবনমান বাড়ানোর ব্যাপারে সহায়তা বা বিনিয়োগ বাড়িয়ে থাকে। যেমন জাপান শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশে যানবাহন, মেশিনারিজ কিংবা কাঁচামাল সরবরাহের জন্য সেসব দেশে বাজার বা চাহিদা সৃষ্টির জন্য সেসব দেশের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে (গাড়ি ব্যবহার বাড়ানোর জন্য) সেতু নির্মাণে সহজশর্তের ঋণ এমনকি প্রয়োজনে অনুদান দিয়ে থাকে। স্বল্পোন্নত দেশে তাদের সামগ্রীর চাহিদা ও সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে সে দেশে আমদানি ও রফতানি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জেট্রোর মাধ্যমে নানান ধরনের প্রণোদনা, কারিগরি সহায়তা প্রশিক্ষণ প্রদান করে তার বাজার নিশ্চিত ও টেকসই করতে। উপনিবেশ দেশগুলোতে উন্নত অর্থনীতির পক্ষ থেকে তাদের জিডিপির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রদানে তারা প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। কেননা একসময় এসব স্বল্পোন্নয়ন দেশ তাদের উপনিবেশ ছিল, তারা তাদের শোষণ করেছিল, এসব দেশের কাঁচামাল পণ্য পুঁজি পাচার করে নিজ নিজ দেশে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠা করে আজ শিল্পোন্নত দেশ হয়েছে। এখন তা পরিশোধের পালা সহায়তা দেয়ার নামে তাদের হাতে রাখা নির্ভরশীল রাখা।

সুতরাং সোশ্যালি রেসপনসিবল ইনভেস্টমেন্টকে দেখানো হয় সেসব দায়বদ্ধতার নিরিখে। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল বাণীও তাই। উন্নত ও অনুন্নতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির অন্যতম উপায় বা মাধ্যম হচ্ছে আর্থ বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টি। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশে দেশে অর্থনীতিতে পারস্পরিক সহযোগিতার নিয়মিত ব্যবস্থাপনার পথ পরিষ্কার রাখা, সম্পর্কের ভিত্তিকে বলশালী করা, টেকসই করা। বার্লিন ইনস্টিটিউট অব কালচারাল ডিপ্লম্যাসি বিশ্বায়নের এ সম্পর্ক পত্তন, দূতিয়ালির মাধ্যমে সেই সম্পর্ককে সংরক্ষণে ও টেকসইকরণের ওপর গবেষণা, অধ্যয়ন ও চর্চাকে আন্দোলনে রূপ দেয়ার পক্ষপাতী। সেজন্য প্রতি বছর বার্লিন ইকোনমিক ফোরাম সম্মেলনের ব্যানারে তারা মুক্ত আলোচনা, ভাব ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আয়োজন করে থাকে। আর এসব আলোচনায় রাজনৈতিক, আর্থ প্রশাসনিক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ ও আহ্বান জানায়। তবে এসব বিশেষ ব্যক্তিত্ব বিশেষজ্ঞ তারা সবাই সাবেক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান ইত্যাদি। কেননা বর্তমানদের এসব সভায় আনার প্রটোকল ঝামেলা যেমন বিস্তর, তেমনি তাদের দিয়ে দাফতরিক মত-মন্তব্য করানোর বা রাখার সুযোগ নানা আনুষ্ঠানিকতার নিগড়ে নিবদ্ধ। সাবেক হলে অভিজ্ঞতার কথা খোলামেলাভাবে বলতে ও শুনতে সুবিধা। ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্য ও বিধেয়র মধ্যে এটা রয়েছে পদস্থজনদের অভিজ্ঞতা এবং অভিমত সংগ্রহ করে জনমত সৃষ্টি, উপলব্ধির অবয়ব সৃষ্টি করা তাদের মূল উদ্দেশ্য।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের
সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement
শ্বশুরের ঘর থেকে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির কাছে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানে অধ্যক্ষ এবং চেয়ারম্যান গ্রেফতার আবারো পিএমএল-এনের সভাপতি হচ্ছেন নওয়াজ শরিফ বিষখালী নদী থেকে ২২ ঘণ্টা পর নিখোঁজ জেলের লাশ উদ্ধার ৩ জেলায় বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ছত্তিশগড়ে ২৯ জন মাওবাদী নিহত হওয়ার পর এলাকায় যে ভয়ের পরিবেশ নেতানিয়াহুকে গাজার কসাই বললেন এরদোগান রাশিয়া ইউক্রেনের ৬৮টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে গুচ্ছ পরীক্ষা দিতে এসে জবি কেন্দ্রে অসুস্থ এক শিক্ষার্থী থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান

সকল