১৬ মে ২০২৪, ০২ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫
`


বাংলাদেশের বাজেটে কৃষি খাত

বাংলাদেশের বাজেটে কৃষি খাত - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ২৯ শতাংশ আসে কৃষি ও তদসংশ্লিষ্ট খাত থেকে। সমতল ভূমির ৯২ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষিকাজে আর কৃষিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে ৬৪ শতাংশ মানুষ। খাদ্যঘাটতির দেশে দানাদার খাদ্যে এসেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। কৃষিপণ্যের রফতানি ছুঁয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। তবে এটি কৃষি খাতের প্রারম্ভিক সাফল্য।

এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, উচ্চ ফলনশীল শস্যের বীজ, উপকরণ, সার ইত্যাদি সরবরাহ, কৃষককে সহজ শর্তে মূলধন জোগান এবং তার উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিপণনের ব্যবস্থা করা এবং কৃষি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে কৃষিকেই দেশের জিডিপির অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে পাওয়া গেছে। একই সাথে কৃষিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠা, পানিসম্পদের সদ্ব্যবহার এবং নদীশাসন ও নৌযোগাযোগ; জনশক্তিকে সম্পদে রূপান্তর ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশীয় কাঁচামালের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে উন্নয়ন-উদ্যোগ গ্রহণে স্থানীয় সঞ্চয়ের বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ, ব্যক্তি তথা বেসরকারি খাতের বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের অন্যতম বাঞ্ছিত ও কাক্সিক্ষত উপায়। স্বয়ম্ভর স্বদেশ এবং এর অর্থনীতির ভিত গড়তে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের যৌক্তিকতা অতীতেও যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। এটি সুনিশ্চিত করতে আসন্ন বাজেটে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পথ-নকশাও থাকতে হবে।

কৃষিতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি বাড়াতে হবে। সরকারের নীতি-সহায়তা বৃদ্ধি ও কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে কৃষি খাত আরো এগিয়ে যাবে। বিশ্বকৃষির বাজারে প্রথম সারির দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ৫০০ কোটি টাকার স্টার্টঅ্যাপ বিজনেস ফান্ডের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক এতে সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে ১ শতাংশ সুদে সহায়তা দেবে। সে ক্ষেত্রে কৃষি উদ্যোক্তাদের এ ঋণের বড় অংশের ব্যবস্থা করা দরকার। এখন বড় চ্যালেঞ্জ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা। সে জন্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প আরো এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। দেশে কৃষিশিল্প গড়তে ১ থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।

পাশাপাশি শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আরো কিছু বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। দেশে-বিদেশে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মার্কেট বড় না হলে কোনোভাবেই এগোনো সম্ভব নয়। অতএব কৃষির রূপান্তর দরকার। প্রয়োজনে কিছু আইন-কানুন বদলাতে হতে পারে। রফতানিমুখী অর্থনীতি তৈরির জন্য কৃষি খাতকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। শিল্পনীতি, কৃষিনীতিতে নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাবে সহায়তা দিতে হবে। উপলব্ধিতে আসতে হবে যে, কৃষির উন্নয়ন ছাড়া স্থিতিশীল উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষি খাতে বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজনে যেসব সুবিধা যেমন- স্বল্প সুদে ঋণ এবং দরিদ্র ও অতিদরিদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ এবং প্রণোদনা বাড়ানো।

ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্রদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কম। তারা তাদের নির্ধারিত ঋণের বড় অংশ বড় খাতগুলোকে দিচ্ছে। কৃষিতে কম দিচ্ছে। কৃষি খাত এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সবাইকে সহায়তা করা। সে তাগিদ আগেও ছিল এখনো থাকবে। বাংলাদেশের কৃষক, ভালো কৃষক। তারা উৎপাদনশীলতায় নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত কৃষি উৎপাদনকারীর সাথে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি রফতানিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ সাফল্য শেষ নয়, শুরু। সরকারের নীতি-সহায়তা বৃদ্ধি ও প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে এ খাত আরো এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কৃষির উন্নতি করতে হচ্ছে বা হবে। এ জন্য কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগের জায়গায় আগ্রহ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় সবধরনের সহায়তা দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থান উন্নত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যেরও একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী জায়গা রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশকে পৌঁছাতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের কৃষক ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অনেক ভালো রয়েছে। দেশের ৬০ শতাংশ অর্থনীতি তাদের ওপর নির্ভর করছে। কৃষকের মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করছে, আর ছেলে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। কৃষি খাতে ব্যক্তি উদ্যোগ অস্বীকার করার অবকাশ নেই। যারা বড় প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, কৃষিকে প্রক্রিয়াজাত শিল্পে রূপ দিয়েছেন, তাদের সহায়তা দিতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ এবং অনিষ্টকারী প্রভাব ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করে কৃষিব্যবস্থাকে সম্ভবমতো নিরাপদ সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ আশানুরূপ হওয়াতেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি সাধনে অনিশ্চিয়তা ও ভবিতব্যের হাতে বন্দিত্বের অবসান ঘটেছে, ঘটবে। তবে গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল শস্যের উৎপাদনে প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটাতে হবে। শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করে সাময়িকভাবে উৎপাদন বাড়ানোর ফলে জমির উর্বরা শক্তির অবক্ষয় ঘটবে। এতে আখেরে চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। খাদ্যশস্যের বর্তমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে কৃষি ও সার্বিকভাবে পরিবেশের যাতে বিপন্ন না হয় সে দিকে লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়।

বাংলাদেশে নদীশাসনের কার্যকর উদ্যোগ তথা পানিপ্রবাহ যথযথ রেখে নদীর নাব্যতা বজায় রাখা আবশ্যক হবে। পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়া হলে কৃষিকাজ তো বটেই, সুপেয় পানির অভাবসহ পরিবেশ বিপন্নতায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাতে পারে বাংলাদেশ। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের মাধ্যমে কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহার দুঃসহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। নৌপথে যোগাযোগের যে নেটওয়ার্ক নদীমাতৃক বাংলাদেশের, তা অত্যন্ত স্বল্পব্যয়ের হওয়া সত্ত্বেও, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের অভাবে সেটিও যাতে ক্রমেই হাতছাড়া না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি দেয়ার ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই। দ্রুত ও সহজ যোগাযোগের উপায় হিসেবে সড়ক নেটওয়ার্কের তুলনামূলক উপযোগিতার বিষয়টি বিবেচনায় আসার অর্থ এই হতে পারে না যে, নৌপথ বিলুপ্তির মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হতে হবে। নৌপথের ন্যায্যবিকাশ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ছাড়াও মৌসুমি বলয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্যও অতি জরুরি। মাছে-ভাতের বাঙালির প্রধান দুই উপজীব্যের অস্তিত্ব ও বিকাশও তো দেশের অগণিত খালবিলের নাব্যতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রকৃত বিনিয়োগ ক্ষেত্র হলো কৃষি। এই কৃষি থেকে খাদ্য, (ভাত, মাছ, সবজি ও শর্করা) বস্ত্র, বাসস্থানের সব ব্যবস্থা হয়। কৃষি খাতকে টেকসই করে তোলার মাধ্যমে অপরাপর সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উন্নয়ন-উদ্যোগ গ্রহণ ও স্বাভাবিক হতে পারে। বাংলাদেশের স্বয়ম্ভর উন্নয়ন ভাবনা এই চিন্তাচেতনাকে অবলম্বন করে হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

কৃষির পরে জিডিপিতে বড় অবদান শিল্প খাতের। অর্থনীতিকে ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার কারণেই বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনীতি হতে পেরেছে। দেশীয় শিল্প সম্ভাবনার উপযুক্ত প্রযত্নের মাধ্যমে স্বয়ম্ভর শিল্পভিত্তি গড়ে ওঠার ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। দেশজ কাঁচামাল দিয়ে প্রয়োজনীয় ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরিতে শিল্প খাতকে সক্ষম করে তোলা এবং এর ফলে বিদেশী পণ্যের ওপর আমদানিনির্ভরতা তথা মহার্ঘ্য বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি ব্যয় হ্রাস, শিল্প ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিনিয়োগ আর বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহারে প্রত্যাশিত অগ্রগতির হিসাবসংক্রান্ত তুলনামূলক পরিস্থিতির সাথে বিশ্ব-অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্পর্কের শুমার ও বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি ও গতিধারা শনাক্তকরণে অসুবিধা হয় না। দেখা যায়, আমদানি ও রফতানির পরিমাণ জিডিপির অংশ হিসেবে ক্রমেই বৃদ্ধি পেলেও রফতানির মিশ্র প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। যদিও অস্থিতিশীল ও ভিন্ন মাত্রিক ট্যারিফ স্ট্রাকচারের প্রভাব পড়েছে বহির্বাণিজ্যে ভিন্ন অনুপাতে। এতে বোঝা যায়, বিশ্ববাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য সাধারণ সূত্র অনুসরণ করতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়েছে। উৎপাদন না বাড়লেও সরবরাহ বাড়ার প্রবণতায় মূল্যস্থিতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। আবার ইনফরমাল বর্ডার ট্রেডের ফলে দেশজ উৎপাদনের বিপত্তি ঘটেছে।

ইনফরমাল ট্রেড বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অদৃশ্য এক অন্ধগলি ও কালো গর্ত হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের আমদানি করা সামগ্রী অন্য দেশে পাচার হয়েছে আবার কোনো কোনো বিদেশী পণ্যের অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে আরোপিত ট্যারিফে দেশী সামগ্রী উৎপাদন ব্যবস্থার স্বার্থের সাথে সঙ্ঘাত হয়েছে।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement
মানিকগঞ্জে সান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের টাকা না দেয়ায় মানববন্ধন চট্টগ্রামে পিকআপ ও সিএনজির সংঘর্ষে নিহত ১ ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় দিনেও রাজশাহীর বানেশ্বর হাট আমশূন্য ভালুকায় আইসক্রিম কারখানায় রান্নার সময় পাঁচকের মৃত্যু আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টারের কর্মপরিধি-সময়সীমা বাড়ছে সিদ্ধিরগঞ্জে চিহ্নিত হয়নি স্বপ্না হত্যার ঘাতক, স্বজনদের মানববন্ধন বান্দরবানে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষ : নিহত ১, আহত ৭ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকা শিবিরে দুঃসংবাদ ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে কুবি শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার গাজা যুদ্ধ : বিভক্ত হয়ে পড়েছে ইসরাইলি মন্ত্রিসভা রূপপুরসহ ১০ প্রকল্পে বরাদ্দ ৫২ হাজার কোটি

সকল