২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলাদেশে ক্যান্সার

বাংলাদেশে ক্যান্সার - ফাইল ছবি

বিশ্বে এখন রোগচিত্রের হিসাবটা বদলে গেছে। বদলে গেছে মৃত্যুর কারণ। কলেরা, টাইফয়েড, বসন্তে মৃত্যুহার নেই বললেই চলে। এসব ছাপিয়ে এখন অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার বেড়েছে। অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার রোগজনিত মৃত্যুহারের ৭০ শতাংশ দখল করে আছে। অসংক্রামকজনিত মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য অনুসারে, পৃথিবীজুড়ে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। আক্রান্তদের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশের। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগের কারণে মৃত্যু ঘটে প্রায় এক কোটি রোগীর। বাংলাদেশে এ রোগের তথ্যবিন্যাসে অসংক্রামক রোগের হার এবং এ কারণে মৃত্যুর পরিসংখ্যানও একই ধরনের। যদিও বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর কোনো সঠিক তথ্যভাণ্ডার নেই- তবুও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত চার দশকে এই রোগের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বহির্বিভাগের একটি পরিসংখ্যানে (২০২৩ সালের) দেখা গেছে, সারা বছরে পাঁচ হাজার ৬৫১ জন ক্যান্সার রোগী চিকিৎসার জন্য এসেছেন। এর ভেতর তিন হাজার ১৩১ জন পুরুষ ও এক হাজার ৫২০ জন মহিলা। পুরুষদের মধ্যে ২০ শতাংশই খাদ্যনালী ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারে ভোগেন। পাঁচ ধরনের ক্যান্সারের রোগী বাংলাদেশে বেশি দেখা যায়। খাদ্যনালী ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার, স্তনক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার। এ ছাড়া ক্যান্সার আক্রান্তদের ৫ শতাংশ শিশু। ৩০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৯ বছর। অন্যান্য উপযোগ (কোমর্বিডিটি) রয়েছে ৪০ শতাংশের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এর ভেতর বছরে মৃত্যুবরণ করে প্রায় এক লাখ আট হাজার ৯৯০ জন রোগী যদিও এ ব্যাপারে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগের মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়, তামাক সংশ্লিষ্টতা ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার (অতিরিক্ত ওজন, ফাস্টফুড, নিয়মিত শরীরচর্চা না করা) অতি বেগুনি রশ্মি, খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল, বায়ুদূষণ-আর্সেনিক, লেড ও ক্রোমিয়াম দূষণ, জরায়ুমুখ প্রদাহ, ভাইরাস সংক্রমণ, অতিরিক্ত জীবাণুনাশক ব্যবহার, মদ্যপান, কম ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণ ক্যান্সার রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার রোগীদের পারিবারিক ক্যান্সারের ইতিহাস পাওয়া যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণ, বেশি বয়সে গর্ভধারণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ক্যান্সার রোগের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি যেকোনো বয়সে হতে পারে। শুধু বয়স্কদের ক্যান্সার হবে, এটিও ভুল ধারণা। ক্যান্সার হলেই মৃত্যু; এ ধারণাও সঠিক নয়। সময়মতো রোগ নির্ণয় করা ও সঠিক চিকিৎসা করা গেলে ক্যান্সার নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০০ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে প্রতি বছর বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ক্যান্সার সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় সেবা-সম্পর্কিত ধারণা বিকাশের লক্ষ্যে এ দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারের ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- Closing the care gap. যদিও সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই, এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা অনেকগুণে বেড়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১৬০টি ক্যান্সার হাসপাতালের প্রয়োজন। প্রয়োজন এক হাজার ৭০০ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

আছে সাকুল্যে মাত্র ৩০০ জন। হাসপাতালের অবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। একই সাথে সহযোগী জনশক্তির (নার্স, টেকনোলজিস্ট) অভাব অত্যন্ত প্রকট। যদিও ক্যান্সার চিকিৎসার প্রায় ৯০ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হয়; কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে অনেকের পক্ষে এ রোগের ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্যান্সার রোগীরা এমন প্রান্তিক অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন যখন চিকিৎসকরাও অসহায় হয়ে পড়েন। ক্যান্সার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব এর প্রধান কারণ। এ জন্যই আমাদের দেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যু হার অনেক বেশি। ক্যান্সার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে রোগীদের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনিভাবে এ রোগের মৃত্যুহারও অনেক কমে আসবে। প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা হাসপাতালগুলোয় এ রোগের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে রোগীদের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। কমে আসবে চিকিৎসা ব্যয়ভার।

বিশ^ ক্যান্সার দিবসের আলোচনা শুধু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে সীমিত না রেখে রোগীদের সম্পৃক্ত রাখলে তারাও মনস্তাত্ত্বিকভাবে উজ্জীবিত হবেন। অপর দিকে, চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যা ঈষড়ংরহম ঃযব পধৎব মধঢ়-এর অনেকটাই পূরণ করবে। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ওপর থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর রেয়াতের ব্যবস্থা করা অথবা স্বল্পমূল্যে এ ধরনের ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দরকার হলে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসসামগ্রীর আমদানির ওপর শুল্কমাত্রা বাড়িয়ে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্যান্সার চিকিৎসা বীমা চালু করার কথা ভাবা যেতে পারে। এ ছাড়াও সব সময় সারা দেশের নির্দিষ্ট কেন্দ্রগুলোতে ওষুধের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশে ক্যান্সার স্ক্রিনিং, সম্ভব হলে চল্লিশোর্ধ্ব সব জনগোষ্ঠীর জন্য বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজন ক্যান্সার সম্পর্কিত জাতীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা। বাজার থেকে ভেজাল ও ক্ষতিকর খাবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর রয়েছে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। মোট কথা, ক্যান্সার রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও চিকিৎসা-পরবর্তী পুনঃপরীক্ষণের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সুযোগ-সুবিধা। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ক্যান্সার সেল গঠন করে একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement