০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একজন ভিনদেশীর দৃষ্টিতে আমরা

একজন ভিনদেশীর দৃষ্টিতে আমরা - নয়া দিগন্ত

ডিসেম্বরের ৪ থেকে ১০ তারিখের শেষ প্রহর পর্যন্ত ছিলাম ভিয়েতনামে বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির আমন্ত্রণে। হো চি মিনের ভিয়েতনাম। ১৮৫৪ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত একাধারে ফরাসি ও মার্কিন বাহিনীর শাসন-শোষণে বিপর্যস্ত ভিয়েতনাম। বিপর্যস্ত হলেও হার না মানা ভিয়েতনাম। আমরা তখন ছাত্র। রেডিওর খবরে, খবরের কাগজে সর্বত্র ভিয়েতনামের খবর। সচিত্র প্রতিবেদন ভিয়েতনাম যুদ্ধের। হো চি মিনের বাণী-সংবলিত উদ্দীপক ছবি। বস্তুত তখন এ দেশের তরুণদের সামনে হো চি মিন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি প্রেরণার নাম, প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি।

সাড়ে ১৩ লাখ ভিয়েতনামির রক্তে ভেসেছে ভিয়েতনাম। মেকং রক্ত লাল হয়ে গিয়েছিল- স্বাধীনতাকামী ভিয়েতনামি জনগণের রক্তে। কিন্তু ভিয়েতনামিরা মাথা নোয়ায়নি। দক্ষিণ ভিয়েতনামের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নগুয়েন ভ্যান থিউ পালিয়ে বেঁচেছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে। দিয়েন বিয়েন ফুর যুদ্ধে যৌথ মার্কিন ও ফরাসি বাহিনীর পরাজয়, মাই লাই হত্যাকাণ্ডে সারা পৃথিবী মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রেও এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় জনরোষ। কিংবদন্তি মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীসহ অনেক তরুণ অস্বীকৃতি জানান বাধ্যতামূলকভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিতে।

স্বাভাবিকভাবে তরুণ বয়সের প্রতিবাদী চরিত্র হো চি মিনের দেশে যাওয়ার একটি প্রচণ্ড ইচ্ছা মনের ভেতর দানা বেঁধে ছিল। সুযোগটি করে দিলো বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটি। তাদের আমন্ত্রণে ভিয়েতনাম যাওয়ার সুযোগটি না হারিয়ে ৪ ডিসেম্বর ভোরবেলা থাই এয়ারওয়েজের বিমানে যাত্রা।

ব্যাংকক হয়ে হ্যানয়। পৌঁছলাম ৪ ডিসেম্বর সকালে। বেশ শীত । বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হ্যানয়ে। অনুষ্ঠান সন্ধ্যাবেলায়। পর দিন হো চি মিনের সমাধিসৌধ দেখে হালং যাওয়ার কথা। হো চি মিনের সমাধিসৌধে সংরক্ষিত রাখা আছে হো চি মিনের লাশ। প্রতিদিন (রোববার ব্যতীত) সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তার লাশ জনসাধারণের দেখার জন্য সুযোগ দেয়া হয়। আমরাও দল বেঁধে লাইনে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই লাশ। ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশাল এলাকাজুড়ে সমাধিসৌধে হাজার হাজার দর্শক এক কিলোমিটারের বেশি লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো শব্দ নেই।

এরপর হোয়ালো জেলখানা, ফরাসি দখলদারদের টর্চার শেল, বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত; দেখার পালা। দুপুরের খাবারের পর হ্যানয়ের বিভিন্ন জায়গা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা। দুটো বিষয় দেখে আশ্চর্য হলাম। প্রথমত, শহরে প্রচুর গাছ সত্ত্বেও কোথাও একটি পাতাও পড়ে নেই। দ্বিতীয়ত, রাজধানী শহর হ্যানয়ে হো চি মিনের সমাধিসৌধ ছাড়া আর কোথাও তার ছবি দেখিনি। দেখা যায়নি তার নামে কোনো রাস্তা বা প্রতিষ্ঠানের অলঙ্করণ-নামকরণ। অথচ ছোট-বড় সবাই ‘আঙ্কল হো’ বলতে অজ্ঞান।

একই দিন বিকেলে হালং বে। বিকেলে গাড়িতে রওনা হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছানো। রাতে হোটেলে থেকে পরদিন ‘বেক্রুজ’। ‘বেক্রুজে’ যাওয়ার পর নিজের কাছে ছোট হয়ে গেলাম। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে কক্সবাজার নিয়ে মাতামাতি করার, ভোট দেয়ার কথা স্মরণ করে। প্রায় দুই হাজার ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নিস্তরঙ্গ নীল পানির বুক চিরে নৌকা, স্পিডবোট বা ছোট ছোট ক্রুজ শিপের কথা ভাবাই যায় না কক্সবাজারে। ভাবা যায় না নিরন্তর পরিষ্কার টলটলে নীল পানির ওপর ভেসে বেড়ানো। সার্ফিং করা, স্টোন পাহাড়ের গুহায় হানা দেয়া; কী নেই সেখানে। সবচেয়ে ভালো লাগল, এত কিছুর মধ্যে নেই কোনো হইচই। অথচ কক্সবাজার পুরো উল্টো।
হ্যালং বে থেকে দানাং। ভিয়েতনাম মার্কিন যুদ্ধের সময় দানাং ছিল মার্কিন বিমানবাহিনীর ঘাঁটি। এখান থেকে বি-৫২ বোমা বিমানগুলো উড়ে গিয়ে হ্যানয়ে বোমা ফেলত। প্রায় ১.৫ মাইল উঁচুতে ফরাসিদের তৈরি শহর দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। মেঘের ভেতর রোপওয়ে দিয়ে এত উপরে উঠে যাওয়া বেশ রোমাঞ্চকর বৈকি! যাত্রাপথে শেষ গন্তব্য হো চি মিন শহর। পূর্ব নাম সায়গন। এখান থেকে সব কিছু ফেলে মার্কিন বাহিনীর চলে যাওয়ার মতো ঘটনার দ্বিতীয় উদাহরণ কাবুল ছেড়ে মার্কিনিদের প্রস্থান। সায়গনের পতনের পর এর নতুন নামকরণ হয় হো চি মিন সিটি। ভিয়েতনামের এটি অর্থনৈতিক রাজধানী। এখানকার জীবনযাত্রা পশ্চিমা ধাঁচের।

এবার দেশে ফেরার পালা। আমাদের ট্যুর গাইড মিসেস হং এবং মিস্টার ডেভিড আমাদের নিয়ে বিমানবন্দরে ছাড়ার জন্য আমাদের সাথী। এ ক’দিন তারা আমাদের সাথে ছায়ার মতো লেগেছিল। সতর্ক যত্ন নিয়েছে। এ ক’দিন আমাদের ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। ভাবলাম, আমাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা কী হয়েছে, জানার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। ভনিতা না করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের ব্যাপারে কী ধারণা হয়েছে এ ক’দিনে। ট্যুর গাইড মিসেস হং পঞ্চাশোর্ধ রাশভারী মহিলা। মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছাপ নেই। মনে হয় পাথরে খোদাই করা একটি মুখ। ভেবেছিলাম একজন ট্যুর গাইড। গাইডের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যাশিত। নির্লিপ্ত অত্যন্ত স্বল্পভাষী মহিলার মন্তব্য শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শুরুটা এভাবে-

‘তোমাদের প্রশংসা করলে আমার কোনো লাভ নেই, আবার সমালোচনা করলেও আমার কোনো ক্ষতি নেই। এ ক’দিন তোমাদের দেখে তোমাদের সাথে মিশে আমার যে ধারণা হয়েছে তা শুনে তোমরা হয়তো অখুশি হবে; তবুও আমি বলছি।
তোমরা শৃঙ্খলার খুব একটা পরোয়া করো না বলে আমার মনে হয়েছে। গোটা ভ্রমণকালীন কিছু নিয়ম-কানুনের কথা বারবার তোমাদের বলা সত্ত্বেও বেশির ভাগ সদস্য তা অনুসরণ করেনি। এ ব্যাপারে তোমাদের ট্যুর লিডারের কথাও তোমরা ঠিকমতো মেনে চলোনি। ফলে তাকে বারবার বিব্রত হতে হয়েছে তোমাদের সামলাতে। ভ্রমণের পুরো সময়জুড়ে তোমাদের বেশির ভাগ সদস্য সময়ের সীমা মেনে চলতে পারেনি। তাদের জন্য বাকি সদস্যদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। সবাই সময়ের প্রতি যত্নবান হলে ভোগান্তি কম হতো। তোমরা বেশির ভাগ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। সহযাত্রী অন্য সদস্যদের সুবিধা ও অসুবিধার প্রতি তোমাদের সামান্যই ভূমিকা আমি লক্ষ করেছি।’

একজন ট্যুর গাইড, যে কোনো দিন বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা নেই বললে চলে। তার সোজাসাপটা মন্তব্য শুনে শুধু মনে হলো- দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত একদল ভ্রমণকারীর কয়েক দিনের কর্মকাণ্ডে আমাদের জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একজন ভিনদেশীর কাছে শোনার পর কোন সাহস ও অহঙ্কার নিয়ে পরিচয় দেবো?

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement