মানবদেহে ইনসুলিন নামক প্রয়োজনীয় হরমোনটির অপ্রতুল নিঃসরণে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ যেকোনো বয়সে সব লোকের হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রতিরোধ করা যায় এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সনাতন সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর উপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, যারা নিয়মিতভাবে সুষম খাবার পরিমিত পরিমাণে খান না, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খেতে অভ্যস্ত তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনায়, মানসিক চাপে, দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায়, আঘাতে, সংক্রামক রোগে, অস্ত্রোপচারে, গর্ভাবস্থায় এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায় বলে অধুনা গবেষণায় প্রতিভাত হয়েছে।
ডায়াবেটিস প্রধানত : দুই প্রকারের : (ক) টাইপ ১ : ইনসুলিননির্ভরশীল এবং (খ) টাইপ ২ : ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিননির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। পক্ষান্তরে ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয় কিংবা প্রয়োজনবোধে সাময়িকভাবে ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়।
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষায় (3D (Diet, Discipline and Drug) অর্থাৎ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়মশৃঙ্খলা ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ও আত্মসচেতনতা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সাথে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদেরও শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারী আকারে ধেয়ে আসা অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব¦ ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২৫ তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশসমূহে ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস উদযাপনে এবারের (২০২৩) প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’। অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে। ‘ডায়াবেটিস রোখো’ এই গুঞ্জন এই প্রয়াস সর্বত্র।
এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রচার প্রচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে আর এ চিকিৎসায় নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবারই শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তারকে থামানো, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে সীমিতকরণ। এবারের প্রচার প্রচারণা মূল ৩ঊ (3E (Education, Engage and Empower) বা তিনটি প্রতিপাদ্যে প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে ‘শিক্ষার’ প্রসার, অধিকসংখ্যক রোগী-অরোগী-চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় ‘সম্পৃক্তকরণ’ এবং ডায়াবেটিস রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ‘ক্ষমতায়ন’।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ আজকের যারা শিশু ও তরুণ তারা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে সেই পরিবেশকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিশেষ দৃষ্টিসীমায় আনতে চাওয়া হয়েছে এজন্য যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপযুক্ত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের ডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষার কর্মসূচি এখনই শুরু করতে হবে। সুষম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং শরীরচর্র্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অর্থাৎ শিশু ও তরুণ সমাজকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের মৌল ধারণা ও সতর্কতা অবলম্বনের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর সেই শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে তারা নিজেরা যাতে এ রোগ প্রতিরোধে সতর্কতা অবলম্বনে আগ্রহী হয় এবং একই সাথে তাদের পরিবার সদস্যদের মধ্যে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে সেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে তাদের তারা সহায়তা করতে পারে। মোদ্দা কথা ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য।
২০২৩-এর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের মূল বাণী তিন ধারায় প্রবাহিত :
সকলের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য শিক্ষা বর্তমান পরিবেশে জীবনযাপনে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং ডায়াবেটিস রোগীদের সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মানসিক চাপ ও বৈষম্যের শিকার সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা, গবেষণা, সংলাপ, প্রকাশনাসহ বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটা সচেতনতার আন্দোলন শুরু করা।
ডায়াবেটিসের বিস্তারের সাথে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত করা হয়েছে এ জন্য যে, ডায়াবেটিসের বিস্তারে ও প্রতিরোধে পরিবেশের রয়েছে বিশেষ প্রভাব। ২০১২ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সংস্থার সাথে ডায়াবেটিস ও অসংক্রামক ব্যাধি নিচয়ের বিস্তাররোধ বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের সাথে সুইজারল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির সেবারের সম্মেলনে ডায়াবেটিস ও জলবায়ুর পরিবর্তনের আনুভূমিক সম্পর্ক সম্পর্কে যৌথ সমীক্ষা চালানোর ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ডায়াবেটিসের বিস্তারবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপে এ উপসংহার ও উপলব্ধি বেরিয়ে এসেছে যে, পরিবেশ ডায়াবেটিস বিস্তারে নিয়ামক ভূমিকায়। গ্যাস নিঃসরণসহ খাদ্য বাসস্থান ও যোগাযোগব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় যে অসম পরিবেশ সৃজিত হয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনকে উসকে দেয় ডায়াবেটিস এর বিস্তারে তাদের রয়েছে আনুভূমিক সম্পর্ক। সংলাপে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়টি প্রাধান্য পায়। বলা হয় একবিংশ শতাব্দীতে ঘাতকব্যাধি ডায়াবেটিস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মানবজাতির জন্য প্রধানতম ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেবে। সংলাপ সভায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের বিস্তারকে বিশ্বব্যাপী সচেতন দৃষ্টিসীমায় আনতে আহ্বান জানানো হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন তথা পরিবেশ বিপর্যয়ের যে প্রভাবক ভূমিকা রয়েছে তা স্পষ্টত- ১. জলবায়ুর পরিবর্তনে ঘটে খরা, সুপেয় পানির দু®প্রপ্যতা, অত্যধিক উত্তাপে ওষ্ঠাগত প্রাণসহ শরীরচর্চার সুযোগ সীমিত হয় বা শারীরিক শ্রমে বাধাগ্রস্ততা সৃষ্টি হয় তা প্রকারান্তরে ডায়াবেটিসের প্রকোপ এবং মাত্রা বাড়ায়। ২. প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষুধা ও দরিদ্রতা বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় গর্ভবতী নারীদের এমন পুষ্টিহীনতায় পেয়ে বসে যে তাদের গর্ভের সন্তান টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ৩. যারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভোগেন তাদের ঔষধ, সুষম খাবার সংগ্রহে ও শরীরচর্চায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ৪. নগরায়ণ ও জনসংখ্যা আধিক্যে স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান খাদ্যাভ্যাস অবলম্বন করা সম্ভব না হওয়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়। ৫. উন্নয়নের অভিঘাতে নগরজীবনে ব্যস্ততা বাড়ে, হাঁটাচলার পথ-ঘাট সঙ্কুচিত হয়, সুষম খাবার ও খাদ্য তৈরির চেয়ে ফাস্ট ফুড গ্রহণ থেকে শুরু করে সর্বত্র একটি কৃত্রিমতা এসে সুষম খাদ্য গ্রহণের সুযোগকে করে সীমিত।
RIO+2 নামে খ্যাত জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন বিশ্ব সম্মেলনে (UN Conference on Sustainable Development) বিষয়টি প্রতিভাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে স্বাস্থ্যই উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে স্বাস্থ্যই সব সুখ বা উন্নয়নের হাতিয়ার। সুতরাং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিধান এবং তার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো উন্নয়নই হবে টেকসই উন্নয়ন। ডায়াবেটিস যেহেতু মহামারী আকার ধারণ করে জনশক্তির বিশেষ করে উৎপাদিকা শক্তির অপচয় এবং একই সাথে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে বর্ধিত ব্যয় নির্বাহে যে আর্থিক ব্যয়বৃদ্ধি ঘটায় সেহেতু ডায়াবেটিসকে শনাক্ত করতে হয় বিশ্ব অর্থনীতি এবং এর উন্নয়নে অন্যতম বাধা হিসেবে।
লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা