১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


চলতে ফিরতে দেখা

থানা চালাতে ওসি সাহেবের অনেক খরচ

থানা চালাতে ওসি সাহেবের অনেক খরচ - নয়া দিগন্ত

পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়- এ রকম বহু অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো সুরাহা হয় না। ঘটনা একেবারে হাতেনাতে প্রমাণিত হলেও পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তি বড়জোর ক্লোজ করা কিংবা চাকরি হেড অফিসে ন্যস্ত করা কিংবা অন্য কোথাও বদলি করা। সবচেয়ে বড় শাস্তির কথা শুনি, সাসপেন্ড করা। সাসপেন্ড তেমন কিছুই নয়, সাময়িক বরখাস্ত। থাক চুপচাপ কিছু দিন, তারপর দেখা যাক, কী করা যায় এবং সাধারণত দেখা যায়, এরা কিছুকাল পরে অন্য কোনো থানায় পোস্টিং পেয়ে চলে যায়। অপরাধের উপযুক্ত শাস্তির খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। এসব প্রশ্রয় পাওয়ার ফলে পুলিশ এখন একেবারেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা প্রকাশ্যে পোশাক পরে ডজন ডজন সিসিটিভির সামনে ব্যাংকে ঢুকে রীতিমতো ডাকাতি করতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি তারা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধর করে একজনের পাঁচটি দাঁত ভেঙে দিয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে সরকার অনেক নাটক করেছে। সাসপেন্ড, বদলি- এসব করে শেষ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে রংপুরে বদলি করেছিল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা কেউই রংপুরে যোগদান করেননি। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইছেন, এই বদলি শাস্তিমূলক, তারা কোনো শাস্তি মেনে নেবেন না।

এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা কোনো না কেনোভাবে সরকারের মদদপুষ্ট। এরকম ঘটনা ডজন ডজন। পুলিশের অফিসাররা এমনও বলেছেন যে, একটি মনমতো পোস্টিং পেতে তাদের ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। তার ওপর থাকে এক থেকে দেড় বছরের মাথায় আবার বদলি। পোস্টিংয়ের খরচা উঠাতেই তাদের সময় চলে যায়, জনসেবা করবে কখন। সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। সেখানে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন।’ ওই অডিওতে পুলিশের ভেতরের চাঞ্চল্যকর নানা বিষয়ও প্রকাশ পেয়েছে। অডিওটি ফাঁসের পর ওই ওসিকে নিয়মমাফিক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

পত্রিকা জানিয়েছে, ছয় মাস আগে চারঘাটের চামটা গ্রামের আবদুল আলিম কালু নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। কালু মাদক ব্যবসায়ী দাবি করে মামলার প্রক্রিয়া শেষে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আছেন। তবে কালুর পরিবার দাবি করেছে, মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। কালুর স্ত্রী সাহারা বেগম বলেছেন, গত ইউপি নির্বাচনে চারঘাটের সলুয়া ইউপির তিন নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন তার স্বামী। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষের সাথে তার স্বামীর বিরোধ হয়। ওই প্রতিপক্ষ ডিবি পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারকে ম্যানেজ করে কালুকে সাজানো মামলায় গ্রেফতার করায়। সাহারার দাবি, তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ ফাঁসিয়েছে। এসব দাবি করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর জেলা পুলিশ সুপারের কাছে অডিও রেকর্ডসহ একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন কালুর স্ত্রী সাহারা বেগম। সাহারা ডাকযোগে পুলিশের আইজি ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কাছে অডিওটি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ছয় মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের অডিওতে ওসি মাহবুবের কণ্ঠে শোনা গেছে- সাত লাখ টাকা ঘুষ পেলে কালুর পরিবারকে মাদক ব্যবসার অনুমতি দেয়া হবে। সূত্র বলছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওসি থানার কম্পাউন্ডে তার শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগমের কাছে এ টাকা দাবি করেন। ওসি বলেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আমি আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছ। কালকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সে রকম সময় নয় যে, কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে, পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া টাকার আর কোনো উৎস নেই।’ গৃহবধূ সাহারা বেগমকে ওসি মাহবুব বলেন, ‘আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে জেলে গেছে। (কালু ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিলেন)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়তে পারব না। মুক্তার বিরুদ্ধে (চারঘাটের মাদক সম্রাট ও সাহারার প্রতিপক্ষ) এখন অ্যাকশন নিতে পারব না। শুভর বিরুদ্ধেও (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারব না। তোমরা পাঁচ লাখ টাকা দিতে পারবা? ওদের ধরে চালান দিয়ে দেবো। থাকি না থাকি, ওদের সাইজ করব আমি। তোমরা এলাকার বাইরে গিয়ে মাদক ব্যবসায় করবে। কোনো সমস্যা নেই। অডিওতে গৃহবধূ সাহারা বেগমের ‘সুন্দর চেহারা’ নিয়েও ওসিকে মন্তব্য করতে শোনা যায়।

একপর্যায়ে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া আর কারো কথা শুনি না।’ তার এমন বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী সংসদ নির্বাচনেও জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার নীলনকশা আঁটছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় থানাগুলোতে এখন থেকেই নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তারই বহিঃপ্রকাশ চারঘাট থানার ওসির কথোপকথন।

এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘুষ আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষকেও হয়রানি করছে ওসি মাহবুবের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম। এ কাজে ডিবি পুলিশও সম্পৃক্ত রয়েছে। বড় মাদক কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক দিকে যেমন মুক্ত পরিবেশে মাদক ব্যবসায় করাতেন তেমনি কারো কাছে টাকা না পেলেই মামলা দিয়ে গ্রেফতার করতেন। কোনো কোনো মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগের বিষয়ে ওসি মাহবুব আলম বলেন, আমার কাছেও অডিওটা এসেছে। কিন্তু কিভাবে হয়েছে আমি জানি না। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে অডিও ফাঁসের পর তাকে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো: রফিকুল আলম বলেন, ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার তিন দিন পর প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অবশ্য বলেছেন, তিনি এ ধরনের কোনো তদবির করেননি।

ওই অডিও ফাঁসের মধ্য দিয়ে পুলিশ ও সরকার দলের রাজনীতিবিদদের চরিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সামনের নির্বাচনে সরকার কী করতে চায় তাও আর গোপন থাকেনি। সরকার যে সামনের নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ ও প্রশাসনকে তাদের অনুকূলে সাজিয়ে নিচ্ছে, মাহবুবের বক্তব্য তার একটি প্রমাণ। ওসি মাহবুব শুধু যে টাকাই চাইছেন এমন নয়, তিনি আটক কালুর স্ত্রী সাহারা বেগমের সুন্দর চেহারা নিয়ে কটূক্তি করে তাকে পরোক্ষভাবে নিগ্রহেরও হুমকি দেন। তদন্ত হলে সব কিছুরই তদন্ত হওয়া উচিত। মাহবুবের ঘুষ দাবি, সাহারা বেগমকে প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং প্রতিমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা সব বিষয়েরই পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া দরকার। তা না হলে সরকার যে দানব সৃষ্টি করেছে, তা তাদের জন্যই বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement