২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মহররম ১৪৪৬
`

শিক্ষার সঙ্কট (পর্ব-০২)

শিক্ষার সঙ্কট - ফাইল ছবি

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। শৈশবের এই আপ্ত বাক্যটি যেন অসহায় এখন আমাদের দেশে। নেলসন ম্যান্ডেলার মতে শিক্ষা এমন একটি অস্ত্র যা বদলে দিতে পারে পৃথিবীকে। ইসলামে শিক্ষাকে ফরজ (অত্যাবশ্যকীয়) ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিবৃত রয়েছে- ‘দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনধর্মী প্রয়োগমুখী ও উৎপাদন সহায়ক করে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা প্রদান করা।’ শিক্ষানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যের সাথে বাস্তবতার সাদৃশ্য মূল্যায়িত হওয়া দরকার। নইলে সরকারি হিসাবে ৩৬ লাখ, বেসরকারি হিসাবে তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত বেকার চাকরির প্রত্যাশায় বছরের পর বছর জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। একটি চাকরির ইন্টারভিউ। ইংরেজি বিষয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া প্রার্থীকে ‘ওথেলো নাটকে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র কে?’ জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিতে পারেননি। অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণী পাওয়া একজনকে অতীশ দীপঙ্কর কে ছিলেন প্রশ্নের উত্তরে জানালেন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে তারা জানেন না বঙ্গভবন ও গণভবনের পার্থক্য কী! রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জানেন না গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বলতে পারলেন না পদ্মা সেতুর আর্থসামাজিক অবদানের কথা। বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেছেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ গ্রন্থের নাম শুনেননি। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমরা নিয়তই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (কয়েকটি বাদে) পড়াশোনার মান এটিই। পড়াশোনার মান নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছেই।

ছাত্ররা পড়াশোনার পরিবর্তে চাঁদাবাজি, টর্চার রুম, বড় ভাই কালচারে অভিষিক্ত হচ্ছে, বইয়ের পরিবর্তে দা, লাঠি, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাজপথ দখলের যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, এটি দৈনিক পত্র-পত্রিকাগুলোতে দৈনন্দিন খবর। কথায় কথায় শিক্ষকের অমর্যাদা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ চিত্র। আদর্শের, নৈতিকতার পরিবর্তে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে নগ্ন দলীয় কোন্দল আজ সাধারণ ঘটনা। ছাত্রদের রাজনীতিবিদরা বিরোধীদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যবহার করছেন। শিক্ষাঙ্গনের এই নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যেও স্মার্ট জাতিগঠনের প্রত্যাশা অবশ্যই আশা জাগানিয়া। কিন্তু শিক্ষার এই বেহাল দশার মধ্য দিয়ে কী করে তা সম্ভব?

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই বিশ্ববিদ্যালয়। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ জাতি ও বিশ্বের কল্যাণে নিত্যনতুন জ্ঞান উদ্ভাবন, সংরক্ষণ ও তার বিস্তার ঘটানো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। এ জন্য মেধা, আগ্রহ ও মননের প্রয়োজন। প্রয়োজন অনুসন্ধিৎসু মন। এ জন্য উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। দেশে এখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তোড়জোড়। শিক্ষক নেই, নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জামের জোগান। শুধু ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এসব বিশ্ববিদ্যালয় দেশে সার্টিফিকেটসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা দিয়ে বিশাল এক অকর্মণ্য বেকারের স্রোত বাড়াচ্ছে। এর বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠানে পেশাগত শিক্ষা দেয়া হয়, সেগুলোর অবস্থা আরো করুণ। হাসপাতাল, প্রয়োজনীয় গবেষণাগার ও শিক্ষক ছাড়াই চলছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে মানুষ বাঁচানোর কারিগর তৈরির কাজ। যারা সচ্ছল তারা চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। গরিব অসহায় মানুষেরাই কেবল তিলে তিলে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে থাকে দেশের মাটিতে।

উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা, চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা এসব একটি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার স্বাক্ষর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই জীবনবোধ, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাথে দায়বদ্ধতার উন্মেষ ঘটানোই উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য। একই সাথে নিত্যনতুন বিষয়ের ওপর গবেষণা এবং তার সুযোগ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংখ্যা ১৬৫। মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০৯টি। ডেন্টাল কলেজ ২৬টি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ৬২টি। ব্যবহারিক সর্বোচ্চ শিক্ষার জন্য এই বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের সমাহার নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা আসলে কী? এসব প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নেই উপযুক্ত গবেষণাগার, নেই গবেষণার সুযোগ। গবেষণা ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীরা শিখবে কী? গবেষণা কার্যক্রমের অভাবে তাদের ভেতর সৃজনশীলতা সৃষ্টি হবে কোথা থেকে?

শিক্ষাবহির্ভূত গঠনমূলক কার্যক্রমের অভাব ছাত্রছাত্রীদের ভেতর বিকল্প চিন্তা ও কর্মের জন্ম দেয়। তারা বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজে অজান্তে জড়িয়ে যায়। পড়াশোনার পরিবর্তে রাজনীতির নামে পেশিবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের কালিমা লিপ্ত করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা আরো করুণ অবস্থায়। শিক্ষকের অভাব, লাইব্রেরির অভাব, ছাত্রাবাসের অভাব, চিত্তবিনোদনের অভাব নিয়তই তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে, হাসপাতালের অভাব। হাসপাতাল নেই, রোগী নেই, অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, ভাবা যায় কি! তত্ত্বাবধানের জন্য রয়েছে মন্ত্রণালয়, অধিদফতর এবং ইউজিসি নামক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই কোনো সৃজনধর্মী কর্মপরিকল্পনা। নিছক ব্যবসায়িক সুবিধার কথা ভেবে অথবা রাজনৈতিক ভাবমর্যাদার জন্য প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় উন্নয়ন কর্মযোগে সামান্যই অবদান রাখছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মযোগী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার দায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মোট কথা, দেশের উপযোগী জীবনমুখী ও উৎপাদনমুখী শিক্ষানীতি যা নৈতিকতার আবহে সিক্ত; দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম ও মানবকল্যাণে অভিগামী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পথ প্রশস্ত করবে, এমন শিক্ষানীতির প্রয়োজন আজ প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে। যারা দেশের নীতি প্রণয়নের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের প্রতি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার সবিনয় অনুরোধ রইল।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement