২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুলিশ কতটা বদলাল

পুলিশ কতটা বদলাল। -

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা জনসমাবেশ নিয়ে উত্তেজনার কথা পাঠকদের মনে থাকার কথা। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়েছিল পুলিশ। অন্য নেতাদের পাশাপাশি দলটির দুই শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে দাগি অপরাধী আসামির মতো ডিবি অফিসে আটক রাখে। সেখান থেকে মামলা দিয়ে তাদের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনো ধরনের নিয়ম কানুন দূরে থাক, ছিটেফোঁটা দয়া মায়া তাদের তখন দেখানো হয়নি। একই পুলিশ ছয় মাসের ব্যবধানে দলটির আরেক শীর্ষ নেতাকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে রীতিমতো জামাই আদর করে চমক সৃষ্টি করেছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আন্দোলনরত অবস্থায় শনিবার পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। তারপর আহত গয়েশ্বরকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। এরপর তার সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছে সেটা ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তার ভাষায় গয়েশ্বর একজন শীর্ষ রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও ‘স্যার’। তিনি তাকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। তার সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আহত হওয়া গয়েশ্বর সবকিছু ভুলে তার জীবনের রোমাঞ্চকর আলাপ আলোচনাও তার সাথে করেন। অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তা তার জন্য পাঁচ তারকা হোটেল থেকে খাবার আনার ব্যবস্থা করেন। তিনি খেতে না চাওয়ায় পরে তার বাসা থেকে আনা দুপুরের খাওয়ার প্লেটে তুলে দেন। সেখানে ছিল কিশোরগঞ্জের অরিজিনাল রুই মাছ। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি অফিসে আসা তার ছোট্ট শিশু সন্তানের সাথে সেলফিও তুলেন। মেরে যারা মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করল তারাই আদর আপ্যায়ন করল।

ফখরুল ও আব্বাসকে গভীর রাতে গ্রেফতার করার ঘটনাটিও এই ডিবি পুলিশ করেছিল। প্রবীণ এই দুই রাজনীতিবিদের বয়সজনিত অসুস্থতাও আছে। ওইসময় তাদের ওই অসুস্থতার কথা বিবেচনা করা হয়নি। গভীর রাতে গ্রেফতার করে বাকি রাত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিবি প্রধান হারুন সাংবাদিকদের তখন বলেছিলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত বুধবার নয়াপল্টনে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেয়ার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।’

বিএনপির অফিসে পুলিশের ওই অভিযান বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি নিন্দনীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। পুলিশ এটিকে অভিযান বললেও সেদিন তাদের মুড ছিল যুদ্ধংদেহী। প্রতিবাদী নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের তারা যেভাবে মোকাবেলা করেছে তাকে শত্রুর ওপর আক্রমণ মনে হয়েছে। ওই অভিযানে বিএনপির একজন কর্মী প্রাণ হারান। আহত হন আরো বহু নেতাকর্মী। রাবার বুলেট, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডে মুহুর্মুহু আওয়াজে এক ভীতিকর যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দলটির অফিসে ঢুকে পুলিশ সব তছনছ করে। নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যায়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের এমন যুদ্ধের অভিযানে নিরস্ত্র মানুষ তাদের রুখে দাঁড়াবে, তার সামান্য সুযোগও ছিল না। ওইসময় দলের মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল গুলি গ্রেনেডের মধ্যে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে একাই অবস্থান নেন। বড় অসহায় হয়ে চেয়ারে বসে তার নেতাকর্মীদের ওপর চালানো নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেন। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে একজন মানুষও এমন ছিল না, ফখরুলের প্রতি সমবেদনা জানাবেন, তার সাথে রাস্তায় অবস্থান নেবেন। রাতে তাকেই আবার ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা ও উসকানির জন্য মামলা খেতে হয়েছে। অথচ একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে ঢোকার জন্য যে অনুমতি নেয়া প্রয়োজন তার তোয়াক্কাও করেনি পুলিশ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন সংস্কৃতি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অপরাধ গণ্য করে পুরোপুরি সামরিক কায়দায় মোকাবেলার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। পুলিশকে সর্বাধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পুলিশের কর্মকর্তারা যে ভাষায় কথা বলেন তাতে নেতাদের পুলিশের অধস্তন বলেই ঠাওর হয়। শনিবার বিএনপির কর্মসূচির দিন দলটির আরেক শীর্ষ নেতা আমানউল্লাহ আমানের সাথে পুলিশ কর্মকর্তা যেভাবে ধমক দিয়ে কথা বলেছেন সেটা কোনোভাবে শোভন হয়নি। আমান তার সাথে পেরে না উঠে জোর গলায় দাবি করছিলেন, আমি চারবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, সরকারের মন্ত্রী হয়েছি। পুলিশের এই দাপট নাগরিক মান মর্যাদাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। কর্মরত পুলিশের সাথে এখন মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। তাদের সাথে ভয় দ্বিধা নিয়ে মানুষ কথা বলে ও মেশে। চিরদিন ক্ষমতায় থাকার সরকারের খায়েশ এই অসুস্থ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। পুলিশকে সীমাহীন রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বহু অবৈধ কাজের আদেশ দিয়েছে সরকার। এজন্যই পুলিশ দাবি করে, এই সরকারকে আমরাই ক্ষমতায় এনেছি ও রেখেছি। তাই মাঠের রাজনৈতিক নেতার কাজও এখন করছে পুলিশ। পুলিশ নিজেও আখের গোছাতে গিয়ে বহু অবৈধ কাজ করে বসেছে। দেশে একটি কথা প্রচলিত হয়েছে, মাছের রাজা ইলিশ; দেশের রাজা পুলিশ। এটি মূলত একটি বিকৃত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার লক্ষণ। এতে বন্দুক সব ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠছে। নাগরিক সাধারণ অধিকারহারা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা পর্যায়ক্রমে সবার জন্য ক্ষতিকর।

মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের সাথে যেমন আচরণ করা হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে বাবু গয়েশ্বর চন্দ্রের জন্য আপ্যায়নের বদলে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ চলত, কঠিন মামলাই নিয়তি হওয়ার কথা ছিল। বর্তমান সরকারকে একটি মামলাবাজ সরকার বলতে হবে। বিরোধী দলকে দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের পাশাপাশি মামলার যথেচ্ছ ব্যবহার তারা করেছে। আগে ছিল মিথ্যা মামলা। সামান্য একটি উছিলা দিয়ে এ মামলা করা হতো। সেজন্য একটি ঘটনা অন্তত ঘটার প্রয়োজন ছিল। এবার এলো এমন মামলা যার জন্য কোনো ঘটনাই আর ঘটার প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের নিশি নির্বাচনকে ঘিরে এ মামলার আবির্ভাব। এই মামলার নাম দেওয়া হলো ‘গায়েবি মামলা’। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দলটির ৩৬ লাখ নেতাকর্মীকে। এগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক করেছে পুলিশ। মামলাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে লাভবান হয় তারা। এ নিয়ে তাদের বিপুল প্রাপ্তিযোগ ঘটে।

পুলিশের ভেতরের পরিবর্তন মোটাদাগে দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ হামলা করেছে বিএনপির লোকদের ওপর। পুলিশ আগের মতো না হলেও কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে হামলা চালিয়েছে। তবে বিএনপির প্রতিবাদী নেতাকর্মীরা পুলিশের সাঁজোয়াযানকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েছে। উত্তেজনার এক পর্যায়ে সেগুলোর চালককে লাঠিপেটা করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। বছরখানেক আগে এ ধরনের প্রতিবাদ করা হলে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা হামলা চালানোর ঘটনায় উসকানি দেয়ার অভিযোগে প্রায় সবাই গ্রেফতার হয়ে যেতেন। এর সাথে অগ্নিসন্ত্রাসের সংযোগ দেখিয়ে দলটির ভেতরে বিস্তৃত পরিসরে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বেশি সময় লাগত না পুলিশের। উচ্চ আদালতে কয়েক দিন আগে এক বিচারক সরকার পক্ষের আইন কর্মকর্তাকে ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ বিষয় আদালত আঙিনায় না টেনে আনার অনুরোধ করেছেন। যা হোক এবার গয়েশ্বর চন্দ্রকে আপ্যায়নের পর তাকে বাসায় পৌঁছে দিলো আমাদের আগের পুলিশ। রাজনৈতিক নেতা, জনসাধারণ নির্বিশেষে পুলিশের কাছে এমন আচরণই পাওয়ার কথা।

তারা এমন আইনানুগ আচরণ পাওয়ার দাবি করেও আসছিল। এই বাহিনীটি সেটাকে কোনোভাবে গণ্য করেনি। তারা সরকারের বৈধ অবৈধ সব আদেশ অত্যন্ত উৎসাহের সাথে তামিল করে গেছে। পুলিশের আচরণগত এই পরিবর্তন এলো এমন একসময় যখন পরাশক্তি আমেরিকা আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ ও নতুন ভিসানীতি কার্যকর করেছে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে, আমরা নিজেরা নিজেদের শুধরাতে পারলাম না। সামান্য যা আমাদের শুধরাল, বাইরের লোকেরা ভয় দেখিয়ে।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement