০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কাছের মেঘালয় অথচ আমাদের থেকে বহু দূর!

কাছের মেঘালয় অথচ আমাদের থেকে বহু দূর! - ছবি : সংগৃহীত

মেঘালয় ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাতটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের একটি। মেঘালয়ের অবস্থান বাংলাদেশের লাগওয়া উত্তর-পূর্বে। মেঘালয় বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী। মেঘালয় অর্থ মেঘের আবাসস্থল। পূর্বে মেঘালয় আসামের অংশ ছিল। ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে না আসা অবধি এ অঞ্চলটিতে খাসিয়া, গারো এবং জয়ন্তিয়া উপজাতিদের নিজস্ব রাজ্য ছিল। ১৮৩৫ সালে এ তিনটি অঞ্চলকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। ব্রিটিশ রাজের সাথে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির কারণে এ অঞ্চলটি অর্ধ-স্বাধীন মর্যাদা পেয়েছিল।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করা হলে মেঘালয়কে পূর্ববঙ্গ এবং আসামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হলে মেঘালয় পুনরায় আসাম প্রদেশের অংশে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় মেঘালয় আসামের অংশ হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি আসাম রাজ্যের দুটি জেলা যথা খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড় এবং গারো পাহাড় সমন্বয়ে মেঘালয় গঠিত হয়।

মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এক হাজার ৪৯৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনামলে শহরটিকে স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট বলা হতো। শিলং-এর আশপাশে রয়েছে অসংখ্য ঝর্ণা। শহরটি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বিরল প্রজাতির অর্কিডের সমাহার।

মেঘালয়ের আয়তন ২২ হাজার ৪৩০ বর্গকিলোমিটার। মেঘালয়ের বর্তমান জনসংখ্যা আনুমানিক ৩৩ লক্ষাধিক। মেঘালয় ভারতের একটি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাজ্য। রাজ্যটির জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ খ্রিষ্টান, ১১ ভাগ প্রকৃতি পূজারী, ৯ ভাগ হিন্দু, ৪ ভাগ মুসলিম এবং অবশিষ্ট ১ ভাগ শিখ, জৈন ও বৌদ্ধ। মেঘালয়ের প্রধান ভাষা খাসি। এ ভাষায় রাজ্যটির প্রায় ৯ লাখ লোক কথা বলে যদিও ভাষাটির কোনো লিপি নেই। মেঘালয় রাজ্যটির জন্মকালীন তিনটি অঞ্চলের দুটি জেলাকে বিভক্ত করে বর্তমানে রাজ্যটিতে ১১টি জেলা গঠন করা হয়েছে।
রাজধানী শহর শিলং থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে ১৩শ’ মিটার উচ্চতায় পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল চেরাপুঞ্জি অবস্থিত। বৃষ্টিবহুল অঞ্চল ছাড়াও কমলালেবুর বাগান, প্রাকৃতিক মধু ও চুনাপাথরের গুহার জন্য চেরাপুঞ্জির খ্যাতি রয়েছে। চেরাপুঞ্জি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মৌসমাই জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটির প্রায় দুুই হাজার ফুট উপর থেকে জলধারা পাহাড়ের পাদদেশে পতিত হওয়ার সময় রংধনুর সাত রঙের প্রতিফলন এক বিরল মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

মেঘালয়ের অর্থনীতি বনশিল্প ও কৃষিভিত্তিক। রাজ্যটির গুরুত্বপূর্ণ ফসল হলো আলু, ধান, ভুট্টা, আনারস, কমলা, কলা, পেঁপে এবং মসলা। রাজ্যটি ভূতাত্ত্বিকভাবে খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও আহরণ ও বাজারজাতজনিত প্রতিবন্ধকতার কারণে এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সড়ক যোগাযোগ দুর্গম হওয়ায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। রাজ্যটিতে প্রায় এক হাজার ১৭০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে রাজ্যটির সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে রাজ্যটির অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটবে যা প্রকারান্তরে রাজ্যটির জনমানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে।

মেঘালয় একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। এটি ভারতের ২১তম রাজ্য। রাজ্যটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বসতি রয়েছে। সড়ক পথই যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। রাজধানী শিলং-এর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও রাজ্যটির অন্যান্য অংশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। রাজ্যের সড়কগুলোর একটি বড় অংশ কাঁচা হওয়ার কারণে সামান্য বৃষ্টিপাতেই যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। আসামের গুয়াহাটির মাধ্যমে রাজ্যটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সড়কপথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। রাজ্যটিতে শিলং বিমানবন্দর ছাড়াও শিলং-এর ৩০ কিলোমিটার দূরে উমরোইতে অপর একটি বিমানবন্দর রয়েছে। তা ছাড়া রেল পথেও এটি আসাম হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত।

মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে পূর্বে বিদেশী পর্যটকদের বিশেষ অনুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল। বর্তমানে তা শিথিল করা হলেও বাংলাদেশী ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পর্যটকদের আগমন তেমন উল্লেখ্য নয়। মেঘালয় রাজ্যটি প্রাকৃতিক বনভূমি সমৃদ্ধ। মেঘালয়ে দু’টি জাতীয় উদ্যান এবং তিনটি বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য রয়েছে।

মেঘালয় রাজ্যে ভারতের লোকসভার দুটি আসন রয়েছে, এর একটি হলো শিলং এবং অপরটি তুরা। মেঘালয়ের বিধানসভার আসন সংখ্যা ৬০। মেঘালয় রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা পরবর্তী এটি আসামের সাবেক গৌহাটি বর্তমান গুয়াহাটি হাইকোর্টের এখতিয়ারভুক্ত ছিল। ২০১৩ সালে মেঘালয়ে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হলে গুয়াহাটি হাইকোর্টের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয়।

মেঘালয়ে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের অবজ্ঞা ও অবহেলার কারণে তা এখনো ফলদায়ক হয়নি। রাজ্যটির বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই সীমিত। এটি পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম হতে বিদ্যুৎ আমদানি করে নাগরিকদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটায়।

মেঘালয় রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো মূল ভারতের অন্যান্য রাজ্য হতে তুলনামূলকভাবে পশ্চাৎপদ। এখানকার শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে মূল ভারতের অন্যান্য রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নে অধিক আগ্রহী যদিও আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগ্রহ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ভারত বাংলাদেশকে তার বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র দাবি করলেও দেশটির অন্যান্য রাজ্যের ন্যায় মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তের ৭০ শতাংশে ইতোমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেছে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনে ভারত বদ্ধপরিকর হলেও তা জিরো লাইনের ১৫০ গজের অভ্যন্তরে হওয়ায় বাংলাদেশের আপত্তির কারণে এর বাস্তবায়ন বাধার মুখে পড়েছে। মেঘালয়ের সাধারণ জনমানুষ তাদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য বাংলাদেশে বিপণনে আগ্রহী কিন্তু দেশটির আইনি জটিলতায় তারা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ কারণে তারা তাদের কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভারতের মূল ভূখণ্ড হতে মেঘালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের সরবরাহ দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সেখানকার মানুষ বাংলাদেশ হতে এসব পণ্যের সরবরাহ গ্রহণে আগ্রহী। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার কারণে মানুষের আকাক্সক্ষা অপূর্ণই থেকে যায়।

বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে লর্ড কার্জন আসাম ও মেঘালয়কে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করে পৃথক প্রদেশ গঠন করেন। লর্ড কার্জনের এ সিদ্ধান্তটি পূর্ববাংলা, আসাম ও মেঘালয় এ তিনটি অঞ্চলের জনমানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সময়োপযোগী, সঠিক ও বাস্তবসম্মত ছিল। বর্ণবাদী হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের কারণে ছয় বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এ অঞ্চলটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস যে বর্ণ হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদেরই দেখা গেল ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণের। ভারত বিভাজন পূর্ববর্তী বাংলা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্র্দী ও স্যার সাদুল্লাহ। জনমানুষের সমর্থন নিয়েই গণতন্ত্রের অনুশীলনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা উভয়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের উভয়ের অবস্থান বাংলা, আসাম ও মেঘালয়ের জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে এ তিনটি অঞ্চল সমন্বয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের সপক্ষে ছিল কিন্তু ভারত বিভাজনের সময় বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বাংলা বিভাজনপূর্বক আসাম ও মেঘালয়কে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করায় এ তিনটি অঞ্চলের অপার সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়। যার বেড়াজালে এ তিনটি অঞ্চলের জনমানুষ আজ অবধি আবদ্ধ।

আশার কথা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল মেঘালয় রাজ্যের চারটি গ্রামের বাসিন্দারা বাংলাদেশের অংশ হওয়ার দাবি জানিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন প্রকল্পে নানা বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন তারা। আর এ কারণেই লর্ড কার্জনের সিদ্ধান্তের সমর্থনে তাদের এ দাবি। যাতায়াত ব্যবস্থা, মোবাইল ও মেডিক্যাল সেবার দিক থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সব প্রকার সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনার কথা উল্লেখ করে এসব গ্রামের অধিবাসীরা বলেন, সিলেট সীমান্ত ঘেঁষা এ চার গ্রামের ৫ সহস্রাধিক মানুষের জীবনজীবিকা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল।

রাজনৈতিক নেতারা যেকোনো দেশের বা অঞ্চলের জনমানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলে দেশ বা অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়। আর তাদের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার তিরোহিত হয়। সেই বঞ্চনার কারণে কাছের মেঘালয় আজ আমাদের থেকে বহুদূর।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement