১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্কট

চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্কট - ছবি : সংগৃহীত

প্রায় বেশির ভাগ উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ইচ্ছা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়া, বিশেষ করে যারা জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। এ বছর এক লাখ ৪৩ হাজার ৯১৫ জন ভর্তিচ্ছু মোট ১০ হাজার ৮৩৯টি আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এদের সবাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মেধাবী শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবারই রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। ১১৩টি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভর্তিও হয়েছেন উত্তীর্ণরা। যথারীতি ক্লাসও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার সুনাম দেশের বাইরেও থাকায় বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে উল্লেøখযোগ্যসংখ্যক বিদেশী ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করেন। তারা এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার জোগানদাতা, অপর দিকে আমাদের চিকিৎসা শিক্ষার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এ দেশে চিকিৎসা শিক্ষার একমাত্র বৈধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। তারা এ দেশে চিকিৎসা শিক্ষার নীতিমালা তৈরি এবং নিয়মিত শিক্ষার গুণগত মান যাচাই করে। তাদের হিসাব অনুসারে, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন প্রভাষক, প্রতি ২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন অধ্যাপক-সহযোগী-সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ১১ সহস্রাধিক শিক্ষক প্রয়োজন। বিপরীতে আছেন মাত্র চার হাজার ৬২৫ জন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বুনিয়াদি বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজন এক হাজার ৯৯৭ জন। বিপরীতে আছেন এক হাজার ২৭৪ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম। অধ্যাপক, সহযোগী, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক মিলে সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজে রয়েছেন এক হাজার ২১৬ জন শিক্ষক, যা প্রয়োজনের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম।

সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ১৪টির নিজস্ব কোনো হাসপাতাল নেই। জেলা সদর হাসপাতালগুলোই সেখানে ভরসা। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অবস্থা আরো ভয়াবহ। এগুলোতে দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের নেই কোনো আবাসিক ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে মেয়েরা এসেই থাকা-খাওয়ার অনিশ্চয়তায় পড়ে। বেশির ভাগ মেডিক্যাল কলেজে নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণ; অভাব ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগের। সীমিত সুযোগে তারা পড়াশোনা করেন। গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব, ক্যান্টিন, কমন রুম বা চিত্তবিনোদনের সুবিধা নেই বললেই চলে।

চিকিৎসা শিক্ষার আরেক নিয়ন্ত্রক স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর ভেতর ১৪টিতে কী ধরনের শিক্ষক আছেন, নিয়মিত শিক্ষক আছেন কি না তা স্বাস্থ্য অধিদফতর সঠিকভাবে বলতে পারে না। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে যাদের চিকিৎসক বানানো হচ্ছে, যারা এ দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হবেন, তারা কতটুকু স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবেন, নিশ্চিত করতে পারবেনÑ এটিই ভাবার বিষয়।

এ অবস্থা কিন্তু একদিনে হয়নি। প্রয়োজনীয় শিক্ষা অবকাঠামোর অভাব এবং শিক্ষকের কথা না ভেবে বিশেষ আনুকূল্যে মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন প্রধান কারণ। শিক্ষকদের নিয়মিতকরণ এবং প্রমোশনের ক্ষেত্রে মেধা, সততা ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তে বিশেষ আনুগত্য প্রাধান্য পাওয়ায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক চাকরি ছেড়েছেন। ফলে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষার পরিবর্তে বিশেষ বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য দেখানোতেই শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য সময় চলে যায়। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিশেষ আনুকূল্য লক্ষ করা যায়। এ অবস্থা বেশি দিন চললে পুরো স্বাস্থ্য অবকাঠামোই ভেঙে পড়তে বাধ্য।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখায়। পরবর্তী সময়ে এগুলোর বাস্তবায়ন না করায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে, আন্দোলন করে। অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এতে এক দিকে যেমন ছাত্রছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; তেমনি দেশের বাইরে আমাদের মেডিক্যাল শিক্ষার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা বিস্তারের কথা একেবারে অমূলক নয়।

প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষা-উপকরণ ও শিক্ষকের ব্যবস্থা ছাড়া নতুন কোনো মেডিক্যাল কলেজের অনুমতি বন্ধ রাখা দরকার। যেসব অভিজ্ঞ মেধাসম্পন্ন শিক্ষক অবসরে গেছেন তাদের ভেতর যারা এখনো পাঠদানে সক্ষম, তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পাঠদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সব মেডিক্যাল কলেজকে কয়েকটি গুচ্ছে ভাগ করে এটি করলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা হলেও শিক্ষক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অপর দিকে, যারা বুনিয়াদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, বিশেষায়িত শিক্ষার ব্যাপারে চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়া খুব জরুরি। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই শিক্ষক সঙ্কট দূরীভূত হতে পারে। এ ছাড়া প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সুবিধা, উন্নত মানের গ্রন্থাগার, শারীরিক ও মানসিক প্রতিভা বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার। আবাসন সুবিধার ফলে বৈকালিক হাসপাতাল প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা নিজেদের তৈরি করতে পারবেন ভবিষ্যৎ জাতির স্বাস্থ্যসেবায় দায়িত্ব গ্রহণের জন্য।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

Email: shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement