১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


সরিষাবীজের নতুন উত্থান

-

‘দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। এ বছর দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে সঙ্কট চলছে। অনেক বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে তেল আমদানি করতে হচ্ছে। এতে এক দিকে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী ভোজ্যতেলের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে আমরা তিন বছর মেয়াদি এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’ (প্রথম আলো, ৯ জুন ২২)

এসব কথা কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের। এই প্রথম বলব কি না ভাবছি, সরকার একটি মৌলিক সঙ্কটের মৌলিক সমাধানের, মৌলিক পথের দিশা দেখালেন। কৃষি আমাদের আসল অর্থনৈতিক শক্তির উৎস। আমাদের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পরও সরকারগুলো সে দিকে মনোযোগী হননি। বলবেন, তারা সব সময় কৃষিকেই প্রাধান্য দেন, দিয়েছেন, দিচ্ছেন। আজকে ধান-চালের উৎপাদন সোয়া চার কোটি টনে পৌঁছানোর পেছনে কাদের অবদান বেশি? সরকার বলবেন সরকারের অবদান। আসলে কৃষকের অবদান বেশি। সরকার অবশ্যই সহযোগ দিয়েছে। কিন্তু কৃষককে প্রণোদনায় ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সরকার তেমন একটা প্রাগ্রসর চিন্তার ফল দেখাতে পারেননি। কম নামে বা নামমাত্র দামে সার দেয়ার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। (জনান্তিকে বলি সার মাগনা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল আর চাল দেয়ার কথা ছিল ১০ টাকা কেজি দরে। আমজনতা কত সরল ও বোকা যে, রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক ওয়াদা হুবহু বিশ্বাস করে এবং ঠকে। আজকে উচ্চমূল্যে সার কিনতে হয়। মোটা চাল কেনে তারা প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে। এটিই হচ্ছে রাজনৈতিক প্রণোদনার বাস্তবচিত্র।)

তেলবীজ উৎপাদনের যে উদ্যোগ ড. আবদুর রাজ্জাক নিয়েছেন তার জন্য অবশ্যই তিনি ধন্যবাদের যোগ্য। কোনো ষড়যন্ত্রের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল দেখিয়ে সরিষাবীজের তেলকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে, তা আজো জানা না গেলেও, সয়াবিনের উচ্চমূল্য ও জেনেটিক্যালি মোডিফাইড সয়াবিন বীজ থেকে জাত সয়াবিন তেলের স্বাস্থ্যঝুঁঁকি আর্থিক ক্ষতি, আমদানি-নির্ভরতা ও মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির পর আজকে কৃষি সেক্টরের প্রজ্ঞাবানরা বুঝতে পেরেছেন। সরিষার তেল স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে তাকে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ড. আবদুর রাজ্জাক নিজে একজন কৃষিবিদ হওয়ায়, বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু সরকারের ভেতরে বসবাসকারী করপোরেট বাণিজ্যের অধিপতিদের এজেন্টদের কারণে সয়াবিন তেল আমদানি-নির্ভরতা কমানো এবং দেশজ ফসল ব্যবহার করার প্রতি ভালোবাসা দেখানো এত দিন সম্ভব হয়নি। এবার সেটি করতে যাচ্ছেন বলে মনে হয়।

খটকা লাগে তখনই যখন বলা হয়, সব কাজই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তো সবার ওপরে আছেনই, তার নির্দেশনায়ই সব কিছু হয়, তার পরও যদি মন্ত্রীরা সংবাদ সম্মেলনে বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় ওই নির্দেশনার কথা বারবার বলেন ও বলতে থাকেন, তা হলে তা বিকট শোনায়। মনে হয়, তিনি যা নির্দেশ দেন তাই কাজ হয়। তিনি নির্দেশ না দিলে কোনো কাজ হয় না বা কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টারের নিজ নিজ বিষয়ে ভাবনারও নেই কোনো প্রজ্ঞা। মনে হয় মন্ত্রীদের মাথা কাজ করে না। প্রধানমন্ত্রীর মাথা সবসময় সচল। তিনি বের করেছেন উচ্চমূল্যের সয়াবিন তেল আমদানি কমিয়ে দেশজ সরিষার উৎপাদন বাড়ালেই ওই আমদানি-নির্ভর পণ্যের খাই থেকে বাঁচা যাবে। এভাবে ঘাটতি মোকাবেলা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে নাকি তাকে ভয় পেয়ে তার নামে এ রকম কথা চাউর করা হচ্ছে? সেটি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। এই তোয়াজবাজি ভালো লক্ষণ নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সময়ও এ রকমটা হতে দেখেছি।

শুধু কৃষির জন্য নয়, এ রকম পরামর্শ আমরা বহুবারই দিয়েছি। সাংবাদিকরা হচ্ছে ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ মার্কা প্রতিভাধর এবং তারা ভাবুক চিন্তাশীল মানুষ, সন্দেহাতীতভাবে। কেবল কৃষির ক্ষেত্রেই নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশের প্রতিভা কাজে লাগানোর বিষয়ে আমরা এ রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি। যেমন আমরা (আমজনতা) খাদ্য বলতে কেবল বুঝতাম ধান-চাল। এর বাইরে সাধারণ মানুষ তেমন একটা সচেতন ছিল না। কিন্তু প্রধান ওই ফসলের মৌলিকত্ব অটুট রেখেই আমরা বলেছি, মাংস উৎপাদনের কথা। বলেছি দুধের খামারের কথা, বলেছি পোলট্রি খামারের কথা, মাছের উৎপাদনের কথা। বলেছি রবিশস্য উৎপাদন বাড়ানোর কথা। সব ধরনের খাদ্য মিলেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। খাদ্য ঘাটতি আর পুষ্টির অভাব একটি জাতিকে মেধাহীন করে দিতে পারে। আমরা সচেতন জাতি প্রমাণ করেছি। বুঝতে পেরেছি নিজেদের প্রয়োজন কতটা জরুরি।

আমরা বলেছি বলেই যে সরকার সচেতন হয়েছে এমনটি নয়। আমাদের কথাগুলো তো কৃষকরা জেনেছে। তারাও এ ভাবে প্রণোদিত হয়েছে। তারাও নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য, নিজেদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নতুন নতুন ফসল নিয়ে আসছেন। আমাদের দেশে এরাবিয়ান খেজুরের উৎপাদনের প্রয়াস বা আমেরিকান অ্যাবাকাডোর মতো অপরিচিত গাছের উৎপাদন ও ফলনের চেষ্টা হচ্ছে। ত্বিন ফল ফলানো হচ্ছে।

এই যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা, তার পেছনে সরকারের হাত নেই, আছে সহযোগিতা, পরের ধাপে উদ্যোক্তাকে প্রণোদিত করতে সরকারই সব থেকে শক্তিশালী সংগঠন, যা জাতির আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে ও যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের কৃষি বিভাগের অগ্রগামী পদক্ষেপ নিতে হয়। হয়তো তারা সে কাজটিও করে। আমরা হয়তো জানি না।

২.
আমাদের কৃষির জমি দ্রুতই কমে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ জন্মহার বেড়ে যাওয়া। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তর থেকে জন্মহারের যে গতি দেখানো হয়, তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আমাদের ছোট দেশে, মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে মাত্র ৫০ বছরে ১৭ কোটি মানুষ হলো কিভাবে? ভূমির পরিমাণ হিসাব করলে জন্মহার ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা জরুরি ছিল। কিন্তু জন্মশাসন নগরাঞ্চলে চললেও বস্তিবাসী ও গ্রামাঞ্চলে নেই বললেই চলে। ফলে গ্রামের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে খানার সংখ্যা। আগে ছিল ৬৮ হাজার গ্রাম, এখন ৮৫ হাজার বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে আমাদের জানানো হচ্ছে। তার মানে কত পতিত জমি ও ফসলি জমিতে বাড়িঘর উঠেছে, কত জমিতে গ্রাম গড়ে উঠেছে। মানুষের সংখ্যার চেয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়েনি। গত বছরও সরকার ছয় লাখ টন চাল আমদানি করেছে। গমও আমদানি করেছেন। পেঁয়াজ-মরিচ, নুন, ডাল, মসলাসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি কতটা তা আমরা জানি না। কৃষিপণ্যের অনেক আইটেমই আমরা আমদানি করে থাকি, বাধ্য হচ্ছি। তাতেও কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা নেহায়েত কম ব্যয় হয় না।

আমরা অমুক ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের এই বানোয়াট কথা বাদ দিতে হবে। রাজনীতিকে ফুলঝুরির বর্ণময় কথার শিল্প থেকে বের করে আনতে হবে বাস্তবে, করুণ, কঠিন, নির্মম সত্যে।

অতীতে যেসব জমিতে বছরে একটি ফসল ফলানো হতো, আজকে সেখানে দু’টি ফসল ফলানো হয়। এটি আমাদের প্রাগ্রসরতারই চিহ্ন। সরিষাসহ অন্যান্য রবিশস্য ফলানোর ক্ষেত্রে যে সময় ও সুযোগ ছিল, আজকের বাস্তবতায় তাকে ভিন্নভাবে সাজাতে হবে। গবেষণা করে বের করতে হবে কত কম সময়ের মধ্যে ফসল বপন ও ফসল তোলা যায়। বীজ মোডিফাই করে কিংবা জেনেটিক্যালি মোডিফাই করে উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর না হয়।

জনগণের কর্মশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে তরুণ সমাজের বেকারদের চাহিদা অনুযায়ী এবং জব মার্কেটের চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষির বহুমুখী সম্প্রসারণ জরুরি। সেখানে জনবলকে শক্তিতে রূপান্তর করাও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগানো যায়। জনশক্তি বহু বছর ধরেই রফতানি করছি আমরা। তবে তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। দক্ষ জনশক্তি রফতানি করার লক্ষ্যে সরকারকে আরো জোরদার ভূমিকা নিতে হবে। বেসরকারি তরফে কিছু ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বটে, তবে তাদের কারিগরি শিক্ষার মান নিয়ে সন্দেহ আছে। ১০ বছরের একটি ক্রাশপ্রোগ্রাম নিয়ে কৃষি সেক্টরের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। দেশের প্রতিটি গ্রামের বাছাই করা বাড়িতে ছোট ছোট দুগ্ধখামার করতে হবে, যা গ্রামের দুধের পুষ্টি-চাহিদা মিটিয়েও নিবন্ধিত দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিকে সরবরাহ করা যায়। ঠিক একইভাবে মাংসের ঘাটতি মেটানো যেতে পারে। পোলট্রি ও ছাগলের খামার, মাছের চাষ, মৌসুমি ফলমূলের চাষাবাদ আমাদের সার্বিক ঘাটতিকে মেকাবেলা করতে পারে।

তোয়াজ করার রাজনীতি, কথার ফুল না ফুটিয়ে নিজেদের কাজ করুন। অন্যের দোষ ধরা সহজ, নিজের দোষ দেখা যায় না, যদি দূরদৃষ্টি না থাকে। সরকারের দূরদৃষ্টি থাকাটা সব থেকে বেশি জরুরি। কিন্তু সেটি তাদের মধ্যে কম। কারণ তারা নিজেরা ভাবেন না। ভাবনার জন্য প্রধানমন্ত্রী আছেন। তিনি নির্দেশনা দিলেই কেবল তারা ও আমরা সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। না হলে উপরের দিকে চেয়ে থাকি কখন নির্দেশনা আসে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল