১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


উপমায় মশা

-

সৃষ্টিশীল মানুষমাত্রই নিজের কাজে তুলনা-প্রতিতুলনা আর উপমা খুঁজে ফেরেন। বিশেষ করে কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে এগুলোর ব্যবহারে যিনি যত বেশি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারেন; সমঝদার পাঠকের কাছে তার সাহিত্যকর্ম তত বেশি আদৃত; সমাদৃত। সাধারণ পাঠকের কাছে তার কদর যায় বেড়ে। সাহিত্যসমালোচক দেখেন সমীহের চোখে। যুৎসই উপমা একটি কবিতাকে দিতে পারে তুমুল পাঠকপ্রিয়তা। রসোত্তীর্ণ হলে হয় কালোত্তীর্ণ, মানে কালজয়ী। সেসব কবি-সাহিত্যিকের অনুরাগী হয়ে থাকেন শিল্পবোদ্ধারা। যেমন, আধুনিক বাংলা কবিতায় উপমার ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন জীবনানন্দ। তার বহুল পঠিত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ পাখির নীড়ের সাথে কবি তার মানসপ্রিয়া বনলতা সেনের চোখকে তুলনা করেছেন। জীবনানন্দের হাত ধরে বাংলা কবিতার এসেছে বাঁকবদল।

অন্য সব শিল্পকলার মতো বক্তব্যও একটি শিল্প। বক্তা হলেন বাচিকশিল্পী। তিনি গুছিয়ে পরিমিত কথা বলতে পারেন, তার মুখনিঃসৃত কথা হয় হৃদয়গ্রাহী। তেমন বক্তা খুব বেশি দেখা যায় না। বক্তব্যের কথা চলে আসায় বলতে হয়, দুনিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা হলেন আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ। তাঁরা আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেছেন সদাসতর্ক অবস্থায়। নবী-রাসূল বাদে দুনিয়ায় হাতেগোনা সুবক্তার হদিস মেলে। সুবক্তা হিসেবে আধুনিককালে মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের নাম আমরা অল্পবিস্তর জানি।

তার বক্তব্য টিকিট কেটে শুনতেন বিদগ্ধজনেরা। মার্ক টোয়েনের বক্তব্য শোনা মানে ছিল বোদ্ধার খাতায় নাম লেখানো। আমাদের এ সময়ে ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা করে ভারতের ডা: জাকির নায়েক রাতারাতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন। তা ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। যেমন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ৭ মার্চের ভাষণ, যা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পেয়েছে। ঠিক তেমনি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে মার্কিন মানবাধিকার সংগ্রামী মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তব্য আজ বিশ্ব ইতিহাসের অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রেসিডেন্সির বিদায়ী ভাষণ বেশ আলোচিত হয়েছে।

হাল জমানায় আমাদের দেশে সরকার পরিচালনায় যারা জড়িত, রাষ্ট্রীয় কাজে প্রতিনিয়ত তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে হয়। বিশেষ করে মন্ত্রীদের। তারা প্রায় প্রতিদিনই দেশের হালফিল অবস্থা জানাতে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে থাকেন। সে অনুযায়ী, এবার বিরাজমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে চিকিৎসকদের সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকা শহরের এডিস মশার বৃদ্ধিকে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে এ দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকুইটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তুলনাটি ব্যতিক্রমী! এর আগে কেউ মানুষের সাথে মশার তুলনা করেছেন বলে জানা নেই। তবে মশার সাথে আশ্রিত ও নিগৃহীত রোহিঙ্গাদের তুলনা করায় তাদের খাটো করা হলো কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এতে মন্তব্যকারীর অহঙ্কার প্রকাশ পায় কি না তাও ভাবনার বিষয়।

স্মৃতিকাতর অনেকের একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য মনে পড়া স্বাভাবিক। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবার সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের শোকগাথা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত গান। ‘নদীর এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা/ সকাল বেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।’ এই গানের দৃশ্যে দেখা যায়, নৌকায় করে পরাজিত সিরাজ নদী পাড়ি দিচ্ছেন। ছবিটিতে অভিনয় করে প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন দর্শকহৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নেন। গণমানুষ তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘মুকুটবিহীন সম্রাট’। তাই কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করতে নেই। অহঙ্কারের চাদর একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। আর একটা বিশেষ কারণে রোহিঙ্গাদের উপহাস করায় মনে খটকা লাগে। অসহায় কাউকে আশ্রয় দিয়ে খোঁটা দেয়া বড়ই দৃষ্টিকটু ও বড় অন্যায়। সব কালে, সব সমাজে এমন আচরণকে মন্দ হিসেবে দেখা হয়।

মশার তুলনা শোনার পর পবিত্র কুরআনের পাঠক মাত্রই মনে পড়বে মহান আল্লাহর বাণী। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মশার উদাহরণ দিতেও কার্পণ্য করেন না’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৬)। আমাদের সাধারণ জ্ঞান বলে, স্রষ্টার কোনো সৃষ্টিই ফেলনা নয়। ‘কোনো কিছুই আল্লাহ অকারণে সৃষ্টি করেননি’-এর প্রমাণ মেলে কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১৯১ নম্বর আয়াতেও। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মনে করে ডেঙ্গু বিস্তারকারী ও রক্তচোষা এডিস মশাকে রোহিঙ্গাদের সাথে তুলনা করলেন, তা আমাদের বিস্মিত করেছে।

যারা তার পারিবারিক পরিচয়টি জানেন, তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তার বাবা কর্নেল অব: মরহুম আবদুল মালেক ছিলেন সাবেক সেনাশাসক এরশাদের আমলের শেষ দিকে ঢাকার মেয়র। পরে মন্ত্রী। শেষ বয়সে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৭ সালে মানিকগঞ্জ সদর আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপিপ্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুল ওহাব খানের কাছে হেরে যান। তিনি ছিলেন দিলখোলা মানুষ। গরিব-দুঃখীকে অর্থ বিলাতে ছিলেন উদারহস্ত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণটি অস্পষ্ট। তার ইনটেনশন কী, তা অজানা। কারণ, অন্তরের খবর জানেন শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আর স্বয়ং অন্তর্যামী। ফেরেশতাদেরও এ ক্ষমতা দেননি আল্লাহ। সেই হিসেবে এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য শুধু তিনিই বলতে পারেন।

এ কথা ঠিক, এতে এডিস মশা জাতে উঠল, নাকি মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো, বোঝা মুশকিল। দেশবাসী বলছেন, আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়ার সময় সতর্ক থাকতে হয়, যাতে মুখ থেকে বেফাঁস কিছু বেরিয়ে না পড়ে। মানুষের কথা হচ্ছে বন্দুকের গুলির মতো; একবার বেরিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। বয়স্করা প্রায়ই একটি কথা বলেন : মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই।

মশা নিয়ে একটি উপকথা প্রচলিত আছে। ওয়াজ মাহফিল, তথা ধর্মীয় জলসায় বয়ান করা হয়। এটি এমন- নবী ইবরাহিম আ:কে অগ্নিকুণ্ডে ফেলেছিল যে অত্যাচারী বাদশাহ, সে ছিল মানবতার শত্রু আর আল্লাহর দুশমন। নাম তার নমরুদ। সেই স্বৈরাচারীর কী হয়েছিল তা বলা হয়েছে কাহিনীতে। গল্পটি এমন- একদিন সভাসদ নিয়ে গল্পে মশগুল স্বৈরশাসক নমরুদ। এমন সময় একটি মশা সোজা তার নাকের ভেতর ভোঁ করে ঢুকে পড়ে। ঢুকে মনের সুখে কামড়াতে থাকে। এতে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে নমরুদ। রাজার এমন দশা দেখে পারিষদরা সাম্রাজ্যের সব বদ্যি-কবিরাজ জড়ো করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই মশা বের করে আনা সম্ভব হয় না। তখন নমরুদ উপস্থিত সভাসদদের কাছে অনুনয় করে বলে, তার মাথায় যেন জুতা দিয়ে পেটানো হয়। মানে, জুতাপেটা করা। অসহায় রাজার ব্যথা উপশমের জন্য পারিষদবর্গ তাই করে। মৃদু আঘাতে কাজ না হলে চলে জোর জুতাপেটা। এতে নমরুদ মারা যায়। তাই মশা নিয়ে কথা বলার সময় সতর্ক থাকা জরুরি। মনে রাখা দরকার, ইয়েমেনের দাম্ভিক বাদশাহ আবরাহার হস্তিবাহিনীও কিন্তু অতিক্ষুদ্র আবাবিল পাখির কঙ্কর নিক্ষেপে পশুর চর্বিত ঘাসসদৃশ হয়ে গিয়েছিল।

বাস্তবতা হচ্ছে, মশা নিয়ে ‘মশকারা’ ঠিক নয়। মশা আকারে ক্ষুদ্র হলেও ভয়ঙ্কর কীট। পৃথিবীতে যত কীটপতঙ্গ আছে, এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এ প্রাণী। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু- সবই বহন করে মশা। শুধু বহন করেই ক্ষান্ত হয় না, সামান্য এক কামড়ে মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে দেয় একজন থেকে আরেক জনের শরীরেও। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো এডিস। জন্মস্থান আফ্রিকা। চার শ’ বছর আগে এর সন্ধান মেলে। এরপর পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামের এক পরিসংখ্যান বলছে, মশার কারণে শুধু এক বছরেই নানা রোগে আক্রান্ত হয় বিশ্বের ৭০ কোটির মতো মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যায় ১০ লাখেরও বেশি। বাংলাদেশে এ বছর এডিস মশার উপদ্রব ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর আমাদের দেশে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে। তাই মুখে যা আসে তাই বলা, শোভন হতে পারে না। বিশেষ করে দায়িত্বশীল পদে থাকলে তো কথাই নেই। পদমর্যাদা বলে একটা কথা আছে। এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে এমন পদে থেকে বিষয়টি হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই। মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ও মন্ত্রীর দায়িত্ব। বাস্তবতা স্বীকার করলে সবার জন্যই তা ভালো।
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল