আমাদের বাংলাদেশের আইনসভার নাম ‘জাতীয় সংসদ’। এর সভ্যরা হলেন ‘সংসদ সদস্য’। জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০টি। সরাসরি নির্বাচন হয় ৩০০টিতে। বাকি ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। এগুলোর জন্য প্রত্যক্ষ ভোটের প্রয়োজন পড়ে না। প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে দলগুলোর অনুকূলে হয় আসন বণ্টন। তাই নারী সংসদ সদস্য হতে দলীয় মনোনয়নই যথেষ্ট। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই বিধান। সংবিধানের আওতায় নতুন নতুন আইন রচনা করাই সংসদ সদস্য বা এমপি মানে, আইনপ্রণেতাদের দায়িত্ব। তাদের নির্ধারিত কাজের একটি হলো, সংসদের অধিবেশনে জনগণের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা।
বিশেষ করে বিরোধীদলীয় সদস্যরা তখন সরকারের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। সরকারদলীয় সদস্যরা পাল্টা যুক্তি দিয়ে তা খণ্ডন করার কথা। সংসদে এই দৃশ্যই স্বাভাবিক। তবে একাদশ জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় এক নারী এমপি জাকিয়া তাবাসসুম গত ২৩ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে গাইলেন গান। মানে, বন্দনাগীত। সংসদে তার পরিবেশিত সঙ্গীত সুকুমারবৃত্তির এক দুর্লভ মুহূর্ত। স্মৃতিকাতর আমাদের মানসপটে এই গান দীর্ঘ দিন দ্যুতি ছড়াতে পারে। তবে তিনিই সংসদে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেননি। আগেও অনেক সংসদ সদস্য তা করে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। এদিকে, তার গানের ভিডিও ফেসবুকে এখন সুপার হিট। জাকিয়ার ধ্রুপদী কণ্ঠের মায়াবী কারুকাজ ও রাগ-রাগিণীর সৌকর্য বর্তমান ডেপুটি স্পিকারকে পর্যন্ত আন্দোলিত করেছে। গানের তালে তালে তাকে বার কয়েক মাথা দোলাতে দেখা গেছে। জাকিয়াকে অতিরিক্ত এক মিনিট সময় দিয়ে সঙ্গীতের সমঝদার শ্রোতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন তিনি। মুগ্ধজনের মতে, এটি তার শিল্পকর্মের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাত।
তার আগে বহু প্রতিভাধর পূর্বসূরি সংসদে শিল্পকলার চর্চা করেছেন। তারা সুযোগ পেলেই দুই কলি গান কিংবা দুই ছত্র স্বরচিত বা বিরচিত কবিতা-ছড়া শুনিয়ে সংসদে সাংস্কৃতিক আবহ তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মহিলা এমপি ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তফা এই সংসদে নির্মলেন্দু গথুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ কবিতাটি কিন্নরীকণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনান। সংসদে উপস্থিত অনেককেই সেই আবৃত্তি মোহাবিষ্ট করেছে। নবম জাতীয় সংসদে আবৃত্তি করে নাম কুড়িয়েছিলেন বিএনপির সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার। তিনি হেলাল হাফিজের লেখা ‘যার যেখানে জায়গা’ কবিতাটি ‘বিপ্লবী’ কণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন। বিএনপির আরেক সাবেক এমপি নীলুফার চৌধুরী ২০১১ সালের ২১ মার্চ ‘নাই, নাই, নাই’ বক্তব্যসর্বস্ব একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। তাতে সবাই বিনোদিত হন। একাধিকবার গান গেয়ে সংসদ মাত করার রেকর্ড গড়েছেন মানিকগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। বেশ কয়েক বছর ধরে গান ও কবিতা সংসদে প্রায় নিয়মিত শুনছেন দেশবাসী। এটি অনেকের কাছেই অমূল্য। তবে টাকার অঙ্কেও এর পণ্যমূল্য নেহায়েত কম নয়। কারণ, জাতীয় সংসদে অধিবেশন চলাকালে এক মিনিটে খরচ হয় এ গরিব দেশের এক লাখ ১১ হাজার টাকা। এর জোগানদাতা দেশের খেটে খাওয়া আমজনতা। রাজকোষে তারাই বিপুল অর্থ সরবরাহ করে থাকেন।
সংসদে আমরা যখন শিল্পকলা দেখে ও শুনে মুগ্ধ, তখন আমাদের পড়শি দেশ ভারতের আইনসভা, যাকে বলা হয় লোকসভা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য মহুয়া মৈত্র ১০ মিনিট ২১ সেকেন্ডের বক্তৃতা দিয়ে পুরো ভারতে আলোচনার তুঙ্গে রয়েছেন। লোকসভায় তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন ছিল এক একটি স্ফুলিঙ্গ, যা পার্লামেন্টকে কাঁপিয়ে তুলছিল মুহুর্মুহু। একজন মহুয়া ২৫ জুন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন, বিজেপির তিন শতাধিক এমপিকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ভারতের নারীবাদী লেখিকা শোভা দে এ বক্তৃতার পর টুইটারে লিখেছেন, ‘একজন রাজনৈতিক তারকার আবির্ভাব’। নতুন লোকসভা প্রায় প্রতিদিন হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া উল্লাসে মুখর। বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ লোকসভা কার্যত ভারাক্রান্ত। তা সত্ত্বেও গত ২৫ জুন ভারতবাসী দেখলেন, ভিন্নমত কত শক্তিশালী হতে পারে। শুধু একটি কণ্ঠ কত তীব্র, কত প্রাণস্পর্শী হতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক পথে একজন রাজনীতিবিদ কতটা আলোড়িত করতে পারেন গোটা দেশকে, তার নজির হলেন মহুয়া।
সেই ভাষণের পর বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেছে। তবু ভারতে হাজারো মানুষ তা ইউটিউবে দেখছেন। ভারতের প্রায় সব প্রচারমাধ্যমের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছেন মহুয়া। তার বক্তৃতা নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা চলে, আরো হবে। বলা হচ্ছে, অনেক দিন পর লোকসভা একটি ‘সাহসী কণ্ঠস্বর’ খুঁজে পেল। ক্রমে দমবন্ধ হয়ে আসা দক্ষিণ এশিয়ায় মহুয়া যেন শান্তির সুবাতাস নিয়ে এলেন। তিনি যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
ভারতে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের উত্থানে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে গভীর উদ্বেগ বিরাজমান। ভারত থেকে প্রায় প্রতিদিন ভিন্নমত দলনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে পাল্টা একটি প্রবল শক্তিও দানা বাধছে, সে খবর আসে না বললেই চলে। বাস্তবে বহু ভারতীয় তরুণ-তরুণী রাজনৈতিক দুঃসময়ে প্রতিরোধ গড়তে শ্রম বিনিয়োগ করছেন। মহুয়া সেই কাতারে শামিল হয়ে পালন করছেন অগ্রণী ভূমিকা। শৈশবে কলকাতা এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে গণিত ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়েছেন। নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যানের হয়ে ব্যাংকিং পেশায় ছিলেন। ২০০৯ সালে স্বদেশে ফিরে যোগ দেন রাজনীতিতে। তখন বয়স তার ৩৪। কিছু দিন কংগ্রেসের যুব শাখায় কাজ করেছেন। দলটির কর্মকাণ্ড মনঃপূত না হওয়ায় সেখানে পাঠ চুকিয়ে মমতার তৃণমূলে যোগ দেন। রাজনীতির কাজে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঘুরতে পছন্দ করেন। ২০১৬ সালে বিধানসভায় জেতেন নদীয়ার করিমপুর থেকে। এবারের লোকসভায় জিতেছেন কৃষ্ণনগর থেকে।
১০ মিনিটের পিনপতন নীরবতায় ২৫ জুন মহুয়া যা করলেন, তা হলো মোদি সরকারকে আয়নায় নিজের মুখ দেখানো। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ভারতে ফ্যাসিবাদের উৎকট স্বরূপ। বিজেপির লোকসভাসদস্যরা বারবার তাকে থামিয়ে দিতে চাইছিলেন। সাহসী মহুয়া ‘চোখ খুলে’ তাদের দেখতে বলছিলেন, ফ্যাসিবাদ কিভাবে আসে একটি দেশে; কিভাবে সমাজে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসে। সেই বর্ণনা আঞ্চলিক, বৈশ্বিক ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ভরা ছিল- যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাতেও বহু মানুষের মনোযোগ কেড়েছে।
মহুয়া কোনো তত্ত্বকথা শোনাননি। তিনি দেখালেন ফ্যাসিবাদ বা কর্তৃত্ববাদের লক্ষণগুলো সমাজদেহে কিভাবে সংক্রমিত হয় ধর্মীয় ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা ব্যক্তিবন্দনার আড়ালে। তিনি কর্তৃত্ববাদের সাতটি লক্ষণের বিবরণ দিয়েছেন। শোনান কৃত্রিম জাতীয়তাবাদের কথা, যা ‘অপর’ ধর্ম ও ভাষাভাষীকে হেয় করে, এ কারণে যা মূলত বর্ণবাদী। এরূপ পরিস্থিতি যে অনিবার্যভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে, তাও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরেছেন।
ফ্যাসিবাদের তৃতীয় ও চতুর্থ লক্ষণ হলো, প্রচারমাধ্যমের গলা টিপে রাখা। প্রসঙ্গক্রমে, সরকারব্যবস্থার সাথে কোনো বিশেষ ধর্ম ও বিশেষ ভাষাকে গুলিয়ে ফেলার দৃষ্টান্তও উপস্থাপন করেন তিনি। এরপর ফ্যাসিবাদের আরো চারটি লক্ষণের বিবরণ দেন, যার মধ্যে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ ছড়ানো এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের দলনকে নিকৃষ্টতম হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইংরেজি, হিন্দি এবং কখনো উর্দুতে বলছিলেন মহুয়া। এ ভাষণ চূড়ান্ত এক উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে পৌঁছায়, যখন তিনি আসামের নাগরিক পঞ্জিতে লাখ লাখ মানুষের ‘বেনাগরিক’ হওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন। এই অপকর্মের হোতা, বিজেপির সদস্যরা তখন হট্টগোল করতে থাকেন। মহুয়া তাদের উদ্দেশে উর্দু কবি রাহাত ইন্দোরির কবিতা উদ্ধৃত করে বলে ওঠেন : ‘সরহি কা খুন হ্যায় শামিল য়াহাঁ কি মিট্টি মেঁ; কিসি কা বাপ কা হিন্দোস্তান থোড়ি হ্যায়।’ বাংলা সরল অর্থ- সবার রক্ত মিশে আছে এখানকার মাটিতে; এ তো কারো বাপের হিন্দুস্তান নয়।
কবিতার এই দুই চরণ দিয়েই শেষ হয় মহুয়ার বক্তৃতা। মহুয়ার এরূপ জ্বলে ওঠায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্যরাও লজ্জায় কুঁকড়ে যান। গত পাঁচ বছর ভারতীয় পার্লামেন্টে এত তীব্রভাবে, বিরোধী দলের কোনো সদস্য ক্ষমতাসীনদের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি। বিষয়বস্তুর মতোই মহুয়ার ভঙ্গিও ছিল আপসহীন ও অকুতোভয়। এককথায়, দর্শনীয়।
এটা ঠিক, সর্বত্র মহুয়া হওয়া সহজ নয়। অনেকেরই সুপ্ত আশা, আমাদের জাতীয় সংসদে কেউ না কেউ ঠিক মহুয়ার মতো সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন কোটি কোটি গণমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে। তখন গান বা শিল্পকলা ভেসে যাবে সেই ঢেউয়ের তোড়ে। তখনই সংসদ সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠবে জনতার কণ্ঠস্বর; যেখানে পাস হবে না কোনো গণবিরোধী কালাকানুন।
আর একটি বিষয় না বললেই নয়। বাংলাদেশের বিশেষত নারীবাদীরা কথাটি মনে রাখলে আখেরে উপকারে আসতে পারে; বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নারীসমাজের অগ্রবর্তী ও সুবিধাভোগীদের যোগ্যতা কতটুকু তা সংসদে জাকিয়ার গান আর লোকসভায় মহুয়ার বক্তব্যের মাঝেই স্পষ্ট। মনে রাখা জরুরি, নারী হলেই নারীসমাজের কল্যাণ করা যায় না। এ জন্য চাই নারীবাদের প্রকৃত পাঠ যাতে নারীর কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়টি শনাক্ত করা যায়। তা না হলে অন্যের হাতের পুতুল হয়ে সমাজে-রাষ্ট্রে উচ্ছিষ্টভোগীর অবমাননাকর জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তখন এটিই হয়ে ওঠে অনিবার্য নিয়তি।
camirhamza@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা