বেল্ট রোড ফোরাম সম্মেলন আমরা কি নাই হয়ে যাচ্ছি
- গৌতম দাস
- ০৪ মে ২০১৯, ২১:২০
![](https://www.dailynayadiganta.com/resources/img/article/201905/407487_176.jpg)
গত ২৫ এপ্রিল ছিল চীনা বেল্ট রোড বিষয়ে দ্বিতীয় সম্মেলন বা সামিট। গত ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সামিটের মতো এবারো এটা বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বলা হয়, বেল্ট রোড মহা প্রকল্পের আইডিয়া চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালের অক্টোবরে কাজাখস্তানের এক সম্মেলন থেকেই প্রথম হাজির করেছিলেন। সেই থেকে ছয় বছরে এই মহা প্রকল্পের মুখ্য নাম একটি-দু’টি থাকেনি, কয়েকটি হাজির হয়েছে। ঠিক যেমন এই দ্বিতীয় সম্মেলনে এর নাম দেয়া হয়েছে বেল্ট রোড ফোরাম বা বিআরএফ।
২০১৭ সালে এর প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে নাম দেয়া হয়েছিল ‘বেল্ট রোড সামিট’। সম্ভবত প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন ছিল সেটি, সে জন্য। ওই দিকে জন্মের শুরুতে এর নাম ছিল সিল্ক রোড প্রকল্প, সিল্ক রুট প্রকল্প, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইত্যাদি অনেক কিছু।
প্রকল্পের আইডিয়া ও এর বাস্তবায়নের বিষয়টি ছিল খুবই ব্যাপক, যে কারণে এটিকে শুধু প্রকল্প না বলে মহা প্রকল্প লিখেছি। আর এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো বিষয়টির বহু কিছুই ইভলভিং বা ফুলের পাপড়ি খোলার মতো বীজ আইডিয়া ক্রমান্বয়ে বাস্তব ও স্পষ্ট হয়েছে। কাজেই বেল্ট রোড মহা প্রকল্পে নতুন নতুন মুখ্য নাম বলাতে বিষয়টি একেক সময় একেকটি, এমন অবশ্যই নয়; বরং বলা যায় একই বেল্ট রোড মহা প্রকল্পের আনফোল্ডিং মানে ক্রমেই ভাঁজ খুলে নিজেকে পূর্ণ আর স্পষ্ট করেছে। আর সেই সাথে অবশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে ক্রমেই নেগোসিয়েশনে বা পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধাগুলো আমলে নিয়ে নতুন বোঝাপড়ায় যাওয়া- এসবের চুক্তি সম্পন্ন করা। ‘ক্রমেই ভাঁজ খোলা’ বলতে আমরা এটাও বুঝতে পারি।
আর যেহেতু দুনিয়ায় এটাই মনে হয় এখন পর্যন্ত এমন সর্ববৃহৎ এক অবকাঠামো প্রকল্প, যা কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের, আর যেখানে জাতিসঙ্ঘের ছোট-বড় মিলিয়ে ১৯৩ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ৭০-এর বেশি রাষ্ট্র এই প্রকল্পের অংশ হয়ে গেছে বা আনুষ্ঠানিক যোগদানের ঘোষণা দিয়েছে। আর প্রাথমিক আগ্রহ জানিয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়েছে মোট ১২৯ রাষ্ট্র। অপর দিকে ওই ৭০ রাষ্ট্র, যারা যোগদানের ঘোষণা দিয়েছে, এদের বড় অংশই হলো এশিয়ান বড় বা উদীয়মান অর্থনীতির, যা ইদানীং ইউরোপের যোগদান হয়ে উঠছে। তবে এখানে এশিয়ার বলতে তা মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ- এভাবে বুঝতে হবে, যেখানে এশিয়া ও ইউরোপ সড়ক ও রেলে সংযুক্ত হচ্ছে এই মধ্য এশিয়াকে মাঝখানে রেখে।
সম্মেলনে যোগ দেয়া রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান কতজন? ২০১৭ সালের প্রথম সম্মেলনে সে সংখ্যাটি ছিল ২৯, আর এবার ২০১৯ সালে দ্বিতীয় সম্মেলনে তা আট বেড়ে হয়েছে ৩৭ জন। এর মধ্যে ইইউর সদস্য এমন রাষ্ট্র ছিল অস্ট্রিয়া ও পর্তুগাল। আর ওই দিকে এশিয়ার মধ্যে যোগ দেয়া রাষ্ট্রপ্রধান এবারো অনেকেই ছিলেন। কিন্তু এশিয়ার এবারই প্রথম রাষ্ট্র বা সরকারের যেসব প্রধান যোগ দিয়েছেন, এমন দুই রাষ্ট্র হলো সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। এতে ১০ সদস্যের আসিয়ান রাষ্ট্র জোটের সবাই এবার যোগ দেন।
বেল্ট রোড মহা প্রকল্প বোঝার সময় এখানে একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, সোভিয়েত যুগের মানে কোল্ড ওয়ার যুগের চিন্তার অভ্যাসে আমাদের মনে গেঁথে থাকা ধারণা হলো, যেখানে নতুন গ্লোবাল নেতা চীনা সেখানে আমেরিকা বা তার জোটের কেউ যোগ দেবেই না। ঠিক যেমন সেকালে সোভিয়েত ব্লকের রাষ্ট্র আমেরিকা ব্লকের রাষ্ট্রের সাথে কোনো অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পর্ক ছিল না, একালেও বোধহয় ঘটনাগুলো সে রকম। এমন ধারণা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। একালে চীন-ভারতের স্বার্থবিরোধের শেষ নেই, অথচ তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশাল; ৮০ বিলিয়ন ডলারের, যা ১০০ বিলিয়নের পথে। খোদ চীন-আমেরিকা কেবল একালেই বাণিজ্যঝগড়ায় হাজির হয়েছে, যা আবার নিরসন মীমাংসারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চীনে আমেরিকান বিনিয়োগ আগের মতোই চলছে, বাণিজ্যও চলছে, যদিও তা বাধা পেয়ে পেয়ে। এক কথায়, একালের বাণিজ্যিক লেনদেনের সম্পর্ক রেখেই অন্যান্য রাষ্ট্রস্বার্থের ঝগড়া চলে। ‘ও পুঁজিবাদ, আমি নই’- তাই সম্পর্ক নেই, এমন ভিত্তি একালে নেই। বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রেখেই যেমন সন্তানেরা অনেকসময় আরো বেশি পাওয়ার জন্য ঝগড়া করে, রাগ দেখায় বা উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে, অনেকটা তেমনই। অর্থাৎ মূল কথা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরের নতুন পরিস্থিতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ হলো- এবার সব রাষ্ট্রই একটি গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ হয়ে যায়। আর পরস্পরের পণ্য, পুঁজি, বিনিয়োগ, বাজার ইত্যাদি বিনিময়ে জড়িয়ে এক গ্লোবাল লেনদেন বিনিময়ের অংশ হয়ে যায়। কিন্তু একই সাথে তারা নিজের যার যার স্বার্থের জন্যও লড়ে যাচ্ছে। ক্যাপিটালিজমের বদ খাসলতগুলোর এখন তাহলে কী হয়েছে? সেগুলো কি মিথ্যা ছিল? অবশ্যই নয়। কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে লড়ার আঙ্গিক, পাটাতন, কায়দা ইত্যাদি সবই এখন বদলে গেছে। তাই লড়াই চলবেই; এমনকি জোট হয়ে বা আলাদাভাবে লড়ার ধরন বদল হলেও। তাহলে এই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বিআরএফের বৈশিষ্ট্য ও অর্জন কী?
কথিত ঋণফাঁদ আর গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড
এই সম্মেলনেও এ দু’টিই মুখ্য ইস্যু হয়েছে। কারণ, শি জিনপিং তার বক্তব্যে নিজেই সোজা প্রতিশ্র”তি দিয়ে শুরু করেছেন, এ দুই ইস্যুকে তিনি এবার মুখ্য বিষয় করছেন। চীনা মিডিয়ার ভাষায় বললে, এই মহা প্রকল্প নিয়ে চীনের কৌশলগত উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে পশ্চিমারা সন্দেহ সৃষ্টি করেছে, প্রেসিডেন্ট শি সেগুলোরই জবাব দিয়েছেন, যাতে সন্দেহ দূর হয়। প্রেসিডেন্ট শি চীনের নেয়া প্রকল্পগুলোতে টেকসই ঋণ, পরিবেশ রক্ষা আর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা- এ দিকগুলো নিশ্চিত করার প্রতিশ্র”তি দিয়েছেন। এ থেকেই মনে হচ্ছে, তিনি পশ্চিমা সমালোচনা, প্রপাগান্ডা ও উদ্বেগগুলোর দিকে মনোযোগী হতে চাচ্ছেন। হংকং-ভিত্তিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকা কিছু এক্সপার্টকে উদ্ধৃত করে আমাদেরকে জানাচ্ছে, এবারে ফোরামে সূক্ষ্ম কিন্তু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু বদল বলতে এগুলোই ঘটেছে। তারা মনে করেন, শি-এর এসব বক্তব্য ছিল খুবই আপসমূলক টোনে। আর খুব সম্ভবত তা আমেরিকা, ভারত, জাপান আর ওই দিকে জার্মানি ও ফ্রান্সের কথা মাথায় রেখে।
ব্যাপারটা হলো, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল অর্থনৈতিক অবস্থায় আমরা এখনো আছি। এটাই ডমিনেটিং। আর এর তৈরি করা মানদ- অবশ্যই আছে; যদিও তা ‘চরম ভালো মানের বা আদর্শের’ এ কথা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। এখন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব ব্যাপারে চীনের এত দিনের অবস্থান ছিল এ রকম- যেন চীন নিজেই একটা স্ট্যান্ডার্ড আর দুনিয়ায় যে স্ট্যান্ডার্ড চালু আছে, তা পশ্চিমা। যেন সে জন্য এটা খারাপ। কিন্তু আসল কথা হলো এ পর্যন্ত দুনিয়ায় যা কিছু স্ট্যান্ডার্ড বা মানদ-, তা নিঃসন্দেহে আমেরিকার নেতৃত্বের দুনিয়াতেই হয়েছে ও আছে। আর তা একেবারে চরম মানসম্পন্ন বা আদর্শ- ব্যাপারটি তা নয়, বরং এর খামতির শেষ নেই, তা-ও হয়তো বলা যাবে। কিন্তু এর কোনো মানদণ্ড নেই- এমন ধারণা করা মানে, নিজেকেই ফাঁকি দেয়া। সারকথা হলো, মানবাধিকারসহ সব বিষয়ে চীন নতুন নেতা হিসেবে নিজের মানদণ্ড বলে কিছু দেখাতে চাইলে তা করতে হবে পশ্চিমা মানদণ্ডকে ভিত্তি ধরে। মানে এর চেয়ে আরো ভালো চীন কী করতে পারে, সেটি দেখাতে হবে। তাই বলাই বাহুল্য, পশ্চিমা মানদণ্ডের নিচে সব কিছুই অগ্রহণযোগ্য হবে।]]
আমাদের মতো দেশে বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্প নেয় তা বেশ কিছু মানদ- মেনে চলে। যেমন- এর একটা হলো, বিশ্বব্যাংকের সাথে অবকাঠামো বিনিয়োগে যে দেশই দাতা-পার্টনার থাকুক না কেন, খোলা প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক টেন্ডারে সাব্যস্ত হবে- কাজ কে পাবে। মানে, ওই দাতা দেশকে কাজ দিতে হবে- এমন কোনো শর্ত নেই। প্রায় সব চীনা প্রকল্পই এই মানদ-ে অচল। সেখানে সাধারণ অভিমুখ হলো, চীনারাষ্ট্র হয় দাতা, ঠিকাদার হবে চীনা কোম্পানি আর তা হবে বিনা টেন্ডারে এবং গুরুত্বপূর্ণ হলো, এক স্থানীয় এজেন্ট কোম্পানি থাকবেই, যার কাজ হবে গ্রহীতা দেশের প্রশাসনকে ঘুষ খাওয়ানো। এটা তো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, এটা চলতেই পারে না। বেল্ট রোডসহ চীনা প্রকল্পগুলো এভাবে চলতে থাকলে চীনের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার।
এর বিপরীতে চীনারা হয়তো বলবেন, আমরা কোনো দেশে পশ্চিমের মতো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করি না, স্টেক নেই; তাই কোনো দেশের দুর্নীতি উচ্ছেদ আমার কাজ নয়। যে দেশ ঘুষ নিয়েই কাজ দেয়, তাকে আমরা ব্যাপক ঘুষ দিই, আর যে নেয় না তাকে সাধি না। তাই ঘুষ দিয়ে কাজ নেবো কি না, সেটা চীন ঠিক করেনি।
আসলে এটা দায় এড়ানোর দায়িত্বজ্ঞানহীন যুক্তি। কারণ, চীনা রাষ্ট্র কোনো নৈতিকতাহীন বাণিজ্যিক কোম্পানি নয়। এ ছাড়া চীন দুনিয়ার অর্থনৈতিক নেতা হতে চায়। কাজেই নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থেকে চীন নেতা হতে পারবে না। অথচ পশ্চিমা মানে, আমেরিকায় রেজিস্টার্ড কোনো কোম্পানির বিদেশে ঘুষ দিয়ে কাজ নেয়া অপরাধ; যদিও এর প্রয়োগ খুবই কম। এটা কিছুটা একালে দেখা যাচ্ছে ওয়ার অন টেররের ইস্যুতে মানিলন্ডারিং আইনের কারণে। এই বাস্তবতা ও মানদণ্ডকে এড়িয়ে পেছনে পড়ে থাকা চীন কিভাবে নেতা হতে পারবে? আমাদের মতো দেশগুলোকে আরো দুর্নীতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী হয়ে চীন কি নেতাগিরির আশা করতে পারে? তাই এককথায় বললে, ব্যাপারটা পশ্চিমা-অপশ্চিমার ইস্যুই নয়।
এটা ঠিক, চীনের নেয়া বেশির ভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক স্বার্থই একমাত্র নয়, এর বাইরে চীনা রাষ্ট্রের একধরনের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ থাকে, যেটা অস্বাভাবিক নয়। যেমন চীন-পাকিস্তানের গোয়াদর করিডোর প্রকল্প। এর নামই বলছে, চীনের ল্যান্ডলকড হয়ে থাকা পশ্চিমা ভূখ-কে মুক্ত করার লক্ষ্যে বন্দর পর্যন্ত করিডোর নেয়াই চীনের স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ প্রকল্পের সুবিধাভোগী একা পাকিস্তান নয়, চীনও। কাজেই ঋণচুক্তির শর্তাবলিতে এর ছাপ থাকতে হবে। যেমন চীনা ঋণ শোধ দেয়ার সময় সাধারণত ২০ বছর হতে দেখা যায়। সে তুলনায় বিশ্বব্যাংকের কনসেশনাল ঋণের মানদ- হলো ৪০ বছরের, যার প্রথম ১০ বছর আবার সুদবিহীন। চীনারাও করিডোর পাওয়া সুবিধাভোগী, তাই একা পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর এর বিপুল ঋণ শোধের দায় চাপানো অনৈতিক ও অবাস্তব। কাজেই এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম ২০ বছর সুদ-আসল পুরো কিস্তিবিহীন হতে পারে। সারকথায়, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস করে পাকিস্তান-চীন উভয়কেই দায় ভাগ করে নিতে হবে, সেটাই হতো ন্যায্য। কিন্তু আমরা দেখছি, পাকিস্তান এখনই ধুঁকছে। এই করিডোর ঋণের কিস্তি যদিও এখনো শুরুই হয়নি, সম্ভবত ২০২২ সালের আগে শুরু হবে না; তখন পাকিস্তানের কী হবে?
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখিয়ে এখনই আমেরিকা এবং আইএমএফ টিটকারি দিচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই চীনের পক্ষে যাচ্ছে না। কাজেই, বাণিজ্যিকের সাথে স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের প্রকল্প হতেই পারে। কিন্তু দায় ভাগাভাগির একটা মানদ- থাকতেই হবে। পাকিস্তানের শাসকেরা চোর ও লোভী বলে চীন এর সুবিধা নিয়ে নিজে দুনিয়ার নেতা হতে পারবে কী করে? এটা কোন বুঝ? বস্তুত কোনো প্রকল্পের অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি মানে প্রকল্প-ঋণ শোধ সম্ভব হবে কি না, এর যাচাই চীন আদৌ করে বলে আমাদের জানা নেই।
কেন? চীন কেন এখানে উদাসীন থাকে? ‘পুঁজিবাদী’ ব্যাপার বলে? চীনের সাফাই কী, আমরা জানি না। অথচ এমন হওয়ার কারণে আইএমএফের প্রেসিডেন্ট মিস লাগার্দের নসিহত শুনতে হচ্ছে চীনকে যে, ‘প্রকল্প গ্রহণের আগে এর ভায়াবিলিটি’ যাচাই কর”ন। এই নসিহত বা কখনো টিটকারি শুনে চীনের কোন ইজ্জত বাড়ছে জানা যায় না। আর এখান থেকেই চীন ‘ঋণফাঁদ’ পেতেছে- এই আমেরিকান প্রপাগান্ডা করার সুযোগ তৈরি করছে চীন নিজেই।
তাহলে কি এখন কানে পানি ঢুকেছে? এবারের বিআরএফ থেকে আমরা কি সেই ইঙ্গিত পাচ্ছি? সম্ভবত হ্যাঁ। কিসের ভিত্তিতে এমন বলা যায়? খুব সহজ। গত মাসে ৯ এপ্রিল চীন-ইইউ সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়। দেখা যায়, এক মানদ- তৈরি মেনে চলা আর এ নিয়ে কাজ করতে চীন সেখানে ইইউর সাথে একমত জানিয়েছে। কাজেই প্রেসিডেন্ট শি আসলে এবারের বিআরএফ থেকে বলতে চাইলেন, তিনি ইইউর সাথে যা যা একমত হয়েছেন, সেটাই এখন বিআরএফ ফোরামেও বাস্তবায়নে কাজ করবেন। যাতে পরের বিআরএফ সম্মেলনে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর আর ফরাসি প্রেসিডেন্টকেও হাজির করতে পারেন। এক কথায় বললে, ট্রাম্পের আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে নেতি প্রপাগান্ডা করেই গেল। আর ইইউ চীনকে মানদ-ে আসতে বাধ্য করল, যাতে সম্ভাব্য নেতা চীনের পার্টনার হয়ে ইইউ নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।
তাহলে এখন বেল্ট রোডে ভারতের কী হবে?
ইইউর মতো ভারতের জন্যও চীনা প্যাকেজ আছে। সম্ভবত চীনা পথ হতে যাচ্ছে, সঙ্ঘাত নয়। বরং আরো সুবিধা অফার করে ভারতকে নিজের নৌকায় তুলে নেয়া হবে। সংক্ষেপে বললে, মাসুদ আজহারের নাম জাতিসঙ্ঘের জঙ্গি তালিকায় তুলতে চীনের আর আপত্তি না করা সেটিরই ইঙ্গিত। তবে এটা কেবল ভারতকে ছাড় দেয়া নয়। অনুমান করা যায়, ভারতকেও প্রতিশ্র”তি দিতে হয়েছে যে, মাসুদ ইস্যুতে ভারত পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা বা সামরিক বা স্ট্র্যাটেজিক কোনো পদক্ষেপে যাবে না। চীন অনেক আগে থেকেই এমন সমাধানের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল। এমনকি সম্ভবত কাশ্মির ইস্যুতে লম্বা পথের হলেও একটা সুরাহা, অন্তত ডায়ালগ শুরু করে পথ খুঁজে পাওয়া- এত দূর পর্যন্ত পরিকল্পনায় আছে। চীন সে জন্য অরুণাচল বা কাশ্মিরের সাথে ম্যাপে কার কোনটা এলাকা-সংক্রান্ত অনেক দাবি থেকেও সরে এসেছে, তা ভারতের মিডিয়াই বলছে। অনেকে অবশ্য অনুমান করে বলছেন, চীনের এত ছাড়ের অর্থ- সে মনে করছে ভারতের চলতি নির্বাচনে মোদি নয়, নতুন সরকার আসছে- এরই ইঙ্গিত। ওই দিকে ভারতের নির্বাচন সমাপ্ত হলে চীনে সেকেন্ড য়ুহান সম্মেলনেরও প্রস্তুতি চলছে।
বাংলাদেশের ভাগে কী?
আপাতত ফুটা কড়ি। নির্বাচিত হওয়ার পরই আমাদের সরকারের ভারতীয় মিডিয়ায় যে হুঙ্কার দেয়া সাক্ষাৎকার, সেটা এখন ফাঁপা বলে হাজির হয়েছে। সেখানে ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করে আমাদের সরকার নিজেই চীনা বেল্ট রোড প্রকল্পসহ চীনের সাথে ব্যাপক সম্পর্কে যাচ্ছে বলে যে ইঙ্গিত, সে ক্ষেত্রে এখন বাস্তবত সরকার মুরোদহীন বলে নিজেকে প্রমাণ করেছে। কারণ, ওই সাক্ষাৎকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ হতো গত ২৫ এপ্রিলের বিআরএফ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে টিম যাওয়া, তা ঘটেনি। একমাত্র ইত্তেফাক বলছে, একা শিল্পমন্ত্রী নাকি গিয়েছিলেন। ইস্যুটিকে মিডিয়া যে অগুরুত্বপূর্ণভাবে ট্রিট করেছে, এতে অনুমান হয়-সরকারের কাছেও এটা অগুরুত্বপূর্ণ; তাই এমন। ভারতের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেয়ার বোল্ড অবস্থানের পর তাহলে এই গুরুত্বহীনতার অর্থ কী?
সোজা অর্থ হলো, ওই দাবি করলেও সরকারের কোনো সক্ষমতা নেই যে, ভারতের স্বার্থের বাইরে গিয়ে নিজ স্বার্থে সে চীনের সাথে কোনো সম্পর্কে যায়। ব্যাপারটি দাঁড়াল এমন যে, নির্বাচিত হলেও ভারতের স্বার্থ থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে কোনো অবস্থান নেয়ার সক্ষমতা সরকারের নেই বলে সরকারেরই অনুমান। তাই আবার স্ট্যাটাস কো; যা ছিল তাই আগের জায়গায়। ভারতের স্বার্থের নিচে চাপা পড়ে থাকা। ইন্ডিপেন্ডেন্ট অবস্থান নেয়ার সক্ষমতা আমাদের সরকারের এখনো নেই। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে, বিসিআইএম মানে- বার্মা হয়ে আমাদের চীনের কুনমিং যাওয়ার এবং সোনাদিয়া বন্দর পুরো প্রকল্পই চীন নাকি গুটিয়ে ফেলেছে।
ফলে বাংলাদেশের জন্য সব কিছুর প্রাপ্তি শূন্য। পেছনের জনসমর্থন ছাড়া এক সক্ষমতাহীন ক্ষমতা বলে চীন-ভারত আমাদের সরকারকে জ্ঞান করছে। তাই ভারতের স্বার্থ পূরণের অগ্রাধিকারের নিচেই চাপা পড়া আমরা। নিঃসন্দেহে তা খুবই হতাশাজনক!
এ দিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলছেন, ‘সরকার চীনের বিকল্প ফান্ড দাতা খুঁজছে।’ শিরোনাম হলো, Bangladesh eyes alternatives to China’s belt and road loans... সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের ২৩ এপ্রিল ছাপা, এর রিপোর্টার বাংলাদেশে এসে ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো ভারতের প্রো-আমেরিকান বিজ্ঞদের বক্তব্য সেখানে ছাপা হয়েছে, যার সারকথা বাংলাদেশের চীনা ঋণে যাওয়া ঠিক নয়। ব্যাপারটা বড়ই রহস্যময়! প্রধানমন্ত্রী চীনা বেল্ট রোডে যোগ দিতে চেয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। আর তিন মাসের মাথায় সরকারের প্রতিমন্ত্রী বলছেন, তারা চীনা বেল্ট রোডের বিকল্প ফান্ড খুঁজছেন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা