২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা ও ভূরাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রক্রিয়া বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর সামনে সন্ত্রাসকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোকে নির্মূলের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন-নিপীড়নের জন্য অপব্যবহৃত হতে থাকে এই ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধ। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে জুলুম-নির্যাতন এখন চরমে পৌঁছেছে। ১৭৯৩-৯৪ সালে ফ্রান্সের রোব্সপিয়ের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিজ দেশের জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে চলছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
উইঘুর : চীনে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং আমৃত্যু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের আল্লাহকে ডাকার পরিবর্তে শি জিন পিংয়ের প্রশংসামূলক স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার অভিপ্রায়ে সেখানকার গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ঘটানো হচ্ছে। অভিযোগ, জোরপূর্বক মহিলাদের সন্তান জন্মদানে অক্ষম করে দেয়া হচ্ছে। দু’জনের বেশি সন্তানের ‘মা’দের বিশাল অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হচ্ছে। কুরআন-হাদিসের বাণী ও শিক্ষা ভুলিয়ে তাদের ম্যান্ডারিন বা চীনা সংস্কৃতি এবং আচার-আচরণের তামিল দেয়া হচ্ছে।
ঝিনজিয়াং চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশ যেখানে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ উইঘুর জনগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের বেশির ভাগই সুন্নি মুসলমান। প্রাচীন বাণিজ্যিক করিডোরের ‘সিল্ক রোড’ পাশেই অবস্থিত এবং তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় চীনের ‘হান’ সম্প্রদায়ের লোকজন চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে ব্যাপকভাবে এসে বসতি স্থাপন করে জাতিগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় উইঘুর সম্প্রদায় প্রতিবাদ করে। এতে ২০০৯ সালে ঝিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে এবং প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর পর থেকেই চীনের সরকার উইঘুর মুসলমানদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে তারা ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের’ নামে বন্দিশালা তৈরি করে সেখানে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে বন্দী করে তাদের জীবন থেকে ধর্মীয় সংস্কৃতিকে জোরপূর্বক মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। চার দিকে ধারালো তারকাঁটা বেষ্টিত ক্যাম্পে হাজার হাজার সিপাহি রাইফেল, তারকাঁটার লাঠি ও টিয়ার গ্যাস নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। সেখানে উইঘুরদের ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে রেখে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, বোরখা পরা এবং বিয়ে ও নামাজে জানাজাসহ সব ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে জোরপূর্বক বিরত রাখছে। অন্য দিকে তাদের ধূমপান, মদ্যপান প্রভৃতি ধর্মীয় নিষিদ্ধ কাজে বাধ্য করছে। সেখানে তাদের বলপূর্বক শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করাচ্ছে। যেসব পরিবারের পুরুষরা ক্যাম্পে আটক, তাদের বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের পাঠানো হচ্ছে যারা সেই বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের সাথে জোরপূর্বক বসবাস করছে। এতে অহরহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আর ক্যাম্পে জোরপূর্বক মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া মেনে নিতে বাধ্য করছে। প্রাপ্ত সংবাদ মতে, সেখানে বাণিজ্যিকভাবে মানুষের অঙ্গচ্ছেদও করা হচ্ছে। ঝিনজিয়াং প্রদেশে এরকম ৩৯টি ক্যাম্পে প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলমান রয়েছে যেগুলোর সর্বমোট আয়তন ১৪০টি ফুটবল মাঠের সমান। প্রতিটি ক্যাম্পে রাত-দিন চলছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। সেই সাথে রয়েছে খাদ্য ও খাবার পানির কষ্ট এবং নির্ঘুম রাত কাটানোর নির্যাতন। সেই এলাকায় প্রায় ২৭টি ফ্যাক্টরি রয়েছে যেখানে উইঘুরদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রায় ৮০ হাজার উইঘুর লোকের চোখ বেঁধে চীনের বিভিন্ন কলকারখানায় রেলগাড়িতে করে নেয়া হয়েছে। ক্যাম্পের বাইরেও পুরো ঝিনজিয়াং প্রদেশ যেন একটি বৃহত্তর কারাগার। প্রত্যেক মুসলমানকে সেখানে অত্যাধুনিক সার্ভেইল্যান্স যন্ত্রের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। নগর ও গ্রামে প্রতি ৫০০ জনের জন্য একটি অঞ্চল নির্ধারণ করে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে তাদের নজরদারি করা হচ্ছে। প্রতি ১০০ গজে একটি করে পুলিশ চেকপোস্ট রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার মসজিদ, খানকাহ, দরগাহ প্রভৃতি ধর্মীয় স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে মুসলিম নির্যাতনকে আইনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। ওই আইনে মুসলমানদের দাড়ি রাখা ও পর্দা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ‘প্রশিক্ষণ শিবিরের’ মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সংশোধনের (!) প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিয়েছে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বিশাল ধর্মীয় জাতিগত বন্দিশালা আর কোথাও হয়নি। সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের নৃশংসতার মূল উদ্দেশ্য হলো উইঘুর অঞ্চলকে মুসলমানমুক্ত করা। কারণ ঝিনজিয়াংয়ের পাশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে চীনের উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামের বিশাল বাণিজ্যিক করিডোর, যাতে অবকাঠামো নির্মাণে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে এবং এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে বৈশ্বিক রাজনীতিতে চীনের প্রভাবও বিস্তৃত হবে।
রোহিঙ্গা : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা (১৯৮৩ সালের আদম শুমারি মোতাবেক) জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল যার বেশির ভাগই মুসলমান। মূলত আরব ব্যবসায়ীদের উত্তরসূরি এই জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছিল। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। ভাষা অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষদের সাথে মিল থাকার সাথে তারা মুসলমান হওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকার তাদের ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে এবং তাদের বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করার অজুহাত খুঁজতে থাকে। এরই মাঝে সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে তারা ছোট ছোট দলে নির্যাতনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকদের চোরাগোপ্তা পথে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। ১৯৯২ সালে এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিল আমাদের দেশে। এভাবে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা আগেই পালিয়ে এসেছিল। এরই মধ্যে মিয়ানমার সরকার রাখাইন অঞ্চলকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনায় আমাদের আরেক বন্ধুরাষ্ট্র চীনেরও জড়িত থাকার কথা জানা যায়। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস মিয়ানমার ও চীনের এই বাণিজ্যিক উদ্যোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ইত্যবসরে একটি দারুণ অজুহাত এসে হাজির হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিলিশিয়া গ্রুপ ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) রাখাইনের ৩০টিরও বেশি পুলিশ চৌকিতে হামলা করে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হলো। অবশ্য ওই আক্রমণ ‘আরসা’ই করেছে নাকি রোহিঙ্গা জাতি নিধনের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য ঘটানো হয়েছে তা আজো প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এ আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২৫ আগস্ট থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং উগ্রপন্থী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের ওপর। ওই আক্রমণে উত্তর রাখাইনের কমপক্ষে ২৮৮টি গ্রাম পুরোপুরি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এতে কমপক্ষে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭৩০ জন শিশুসহ প্রায় ছয় হাজার ৭০০ জন রোহিঙ্গা নির্বিচারে নৃশংসভাবে নিহত হয় (বিবিসি নিউজ, ২৩ অক্টোবর ২০১৯)। সেই সাথে আক্রমণকারী সেনারা রোহিঙ্গা নারী ও বালিকাদের গণধর্ষণে লিপ্ত হয়। ওই বর্বর নির্যাতন থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কোনো মতে পালিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। নৌকায় করে পালিয়ে আসতে গিয়ে আরো প্রায় শত লোকের সলিল সমাধি হয় বঙ্গোপসাগরে। সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই সেনাসদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে পৌঁছে এই হত্যাযজ্ঞের কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা হত্যা অভিযানে নামার আগে তাদের কমান্ডাররা আদেশ দিয়েছিলেন, ‘ছেলে-বুড়ো যাকে দেখবে, তাকেই হত্যা করবে’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য তারা জীবন বাজি রেখে যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারস্থ টেকনাফে এসে পৌঁছেছে। জাতিসঙ্ঘের বর্ণনায় এই বর্বরতা হলো ‘ঞবীঃনড়ড়শ বীধসঢ়ষব ড়ভ বঃযহরপ পষবধহংরহম’ অর্থাৎ জাতিগোষ্ঠী নিধনযজ্ঞের উদাহরণের পাঠ্যপুস্তক স্বরূপ এই গণহত্যার ঘটনা। সব মিলে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ (ৎবষরবভবিন, ২৯ মার্চ ২০১৮) রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কক্সবাজার জেলার ১৩টি স্থানে তারা বিভিন্ন শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
কাশ্মির : ১৯৪৭ সালে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে নির্ধারিত হয়। ‘রাজা’ শাসিত বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারত ও পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির রাজ্যের হিন্দু মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। এরই মধ্যে কাশ্মিরের জনগণ পাকিস্তানের সাথে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় কাশ্মিরের সীমান্তসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের পশতুন সম্প্রদায়ের লোকজন কাশ্মিরিদের সহায়তার জন্য কাশ্মিরে প্রবেশ করে। ফলে মহারাজা হরি সিং ভারতের অনুর্ভুক্তির জন্য চুক্তি স্বাক্ষর এবং সাহায্যের আবেদন করায় ভারত কাশ্মিরে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। এতে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। পরে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপে উভয়পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং পুরো কাশ্মির অঞ্চলের ১/৩ ভাগে পাকিস্তান এবং বাকি অংশে ভারতের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মাঝখানে নিয়ন্ত্রণ রেখা (খরহব ড়ভ ঈড়হঃৎড়ষ) বা অস্থায়ী সীমান্তরেখা আরোপিত হয়। এ অবস্থায় ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজিত করার মাধ্যমে কাশ্মিরকে ‘বিশেষ মর্যাদায় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সাংবিধানিক মর্যাদা পেলেও কাশ্মিরিদের জীবনে শান্তি কখনো আসতে পারেনি। কারণ ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মিরের জনগণ তাদের গণরায়ের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে অথবা বিবদমান দেশ দু’টির যেকোনো একটির সাথে একীভূত হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ১৯৫৩ সালে ওই গণভোট অনুষ্ঠানের প্রতিজ্ঞা পুনর্ব্যক্ত করলেও জাতিসঙ্ঘের সেই ফায়সালা গত সাত দশকেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে কাশ্মিরের জনগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই ঠিক করবে। তারা ১৯৮৯ সালে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য ভারত সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং কাশ্মিরে সন্ত্রাস দমনের নামে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। ফলে এই স্বাধীনতা আন্দোলনে কাশ্মিরে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয় গত ৩০ বছরে। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ ভারতকে জম্মু ও কাশ্মিরের গুম ও গণকবরের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। আর প্রধানমন্ত্রী হন ‘গুজরাটের কসাই’ নামে সমালোচিত নরেন্দ্র মোদি। ২০১৯ সালে তিনি হিন্দুত্ববাদী জোশের ওপর ভর করে একটি ‘ভূমিধস’ বিজয় অর্জন করে পুনরায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার এই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে পুরো ভারতের আকাশ কট্টর হিন্দুত্ববাদের কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভারতজুড়ে শুরু হয় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন। বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের অযৌক্তিক রায় প্রকাশিত হয়, যা তথ্য ও আইনগত উপাদানের পরিবর্তে বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া বাবরি মসজিদের স্থানে রুপার ইট গেঁথে রামমন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তিনি নিজে এ সময় পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন। তিনি বলেন, পুরো ভারত আজ রামময়। অন্য দিকে আসামের লাখ লাখ মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার জন্য নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে এবং সারা ভারতের মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বা সিএএ জারি করা হয়। এই নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আবরণে একতরফাভাবে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় অর্ধশত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। এ দিকে গত বছরের ৫ আগস্ট মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় পার্লামেন্ট সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা একতরফাভাবে বাতিল করে কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা বাতিল করে দেয়। এর আগে তারা কাশ্মিরে এক কোটি ১৩ লাখ মানুষের জন্য প্রায় ৯ লাখ সেনা মোতায়েন করে। ১৪৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্কসহ ছয় হাজার ৬০৫ জন রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার হন। গত এপ্রিল মাসে ভারত সরকার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবার সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদও বাতিল করে অমুসলিম ও অ-কাশ্মিরিদের ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কাশ্মিরে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ফলে এরই মধ্যে ২৫ হাজার বহিরাগত কাশ্মিরের বাসিন্দা হিসেবে সনদ পেয়ে গেছে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর হাতে চলছে নিত্যদিনের হত্যাযজ্ঞ। সন্ত্রাস দমনের নামে তারা বিগত পাঁচ মাসেই ১২০ জনেরও বেশি কাশ্মিরিকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে নিরপরাধ নাবালক শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এই নির্যাতন মানবতাবিরোধী এক জঘন্য অপরাধ। জাতিগতভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। যুগে যুগে এই ধরনের নির্যাতনের যাঁতাকলের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট উগ্রবাদ বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকির সৃষ্টি করেছে। আর তখন সেই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ধর্মকে বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এই উগ্রবাদের জন্য কলঙ্কিত করা হয়েছে। কাজেই দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে; অন্যথায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার সাথে সাথে সারা বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এর প্রভাব। যেকোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠী জাতিগত নিধনের শিকার জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের সুযোগে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আবার ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস পেতে পারে বা একে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। হ
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ঊসধরষ : সধশংঁফ২৬৪৮@ুধযড়ড়.পড়স
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা