১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১, ৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইভিএম নাকি যানজট নিরসনÑ কোনটি জরুরি

সুশাসন
-

ইভিএম তথা ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন’ হচ্ছে ভোটদানের একটি যন্ত্রের নাম। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেয়া হলে ভোট দেয়া সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পর ভোটের ফলাফল জানা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম প্রচলন-পরবর্তী সময়ে যখন দেখা গেল এটি কারচুপি-সহায়ক এবং এর মাধ্যমে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, তখন থেকে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। পৃথিবীর যেসব উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ চালু হয়েছিল, এর অনেকগুলোই এখন ইভিএম থেকে সরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যায় ইউরোপের অন্তর্ভুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্য এ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠার কারণ হলো, নীতি ও নৈতিকতার বিচারে সে দেশের মানুষের অবস্থান পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক উচ্চে। ইভিএমের পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। পৃথিবীর যেসব দেশে ইভিএম নামে ভোটিং যন্ত্র চালু হয়েছিল বা চালু আছে, এর প্রতিটি এ যন্ত্রটি নিজ দেশে উৎপাদনে সক্ষম।
আমাদের বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বর্তমানে দেশটিতে বেকারের সংখ্যা চার কোটির অধিক। জাতীয় সংসদের নির্বাচন একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। আমাদের দেশে একটি নির্ধারিত দিন জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এ নির্বাচন পরিচালনায় যে বিপুল জনবলের প্রয়োজন, নির্বাচন কমিশনের নিজের তেমন জনবল নেই। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য যেরূপ জনবলের প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি সেরূপ জনবল দেয়ার জন্য সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনকে এর দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও এর হালনাগাদ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এ কাজ সম্পন্ন করতেও বিপুল মানুষের সেবা নিতে হয়। ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও হালনাগাদের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়ে থাকে। বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে কখনো ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কখনো জনবলের সঙ্কটে পড়েনি। ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যেসব ব্যক্তির সেবা গ্রহণ করা হয়, এদের বেশির ভাগই প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি। গত দু-তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় বেসরকারি সংস্থার চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সহায়তা নেয়া হয়েছিল। এরূপ সহায়তা নেয়া আইনগতভাবে বারিত নয়।
নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন শৃঙ্খলাবাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে হয়। আমাদের শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সেনা, নৌ, বিমান ও পুলিশ বাহিনীসহ আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবাহিনী হিসেবে ঘোষিত অপর যেকোনো বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ছাড়া অপর সব বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে উপরিউক্ত সব বাহিনী বা যেকোনো বাহিনীকে সম্মিলিত বা এককভাবে নিয়োগ করা যায়। উপযুক্ত বাহিনীগুলোর সদস্যসংখ্যা পর্যাপ্ত থাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচন কমিশন শৃঙ্খলাবাহিনী বা আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়বে, এমনটি অনুভূত হয় না।
ভোট গ্রহণ ও গণনার কাজে ব্যক্তিমানুষের শ্রম ব্যবহার করা হলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তা ইভিএমের মাধ্যমে করা হলে ব্যয়ের পরিমাণ কয়েক গুণ অধিক। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ও গণনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিমানুষ সৎ, দক্ষ ও আন্তরিক হলে তাদের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্য সম্পন্ন করে ফলাফল ঘোষণা কোনো কঠিন কাজ নয়। তবে তাদের এ কাজ কঠিন হয়ে পড়ে যদি ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য তাদের ওপর অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ করেন।
নির্বাচন চলাকালীন ক্ষমতাসীন দল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক হলে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে কখনো সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায় না। আর তাই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দল আগ্রহী হলে নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ও গণনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সততা ও নিষ্ঠাবিবর্জিত হবেন, এমনটি আশা করা যায় না।
ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে অথবা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক না হলে তা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা অথবা ইভিএম উভয়ের মাধ্যমে সম্ভব। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম সংযুক্তির পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের যে যুক্তি তা হলো ভোটের স্বচ্ছতা। ইভিএম স্বচ্ছ নাকি অস্বচ্ছ ভোট নিশ্চিত করবে, তা নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের মনোভাবের ওপর। ক্ষমতাসীন দল ভোটের ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে তা যে ইভিএম অথবা ভোট গ্রহণ ও গণনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি উভয়ের মাধ্যমে সম্ভবÑ এ বিষয়টি আজ দেশের মানুষের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার বিষয়ে বর্তমানে যে বিধান রয়েছে, তা হলো একজন ভোটার গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তার ভোট দেবেন। ইভিএমে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যালট পেপারের প্রয়োজন হয় না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট প্রদানব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হলে আমাদের বিদ্যমান নির্বাচনী আইনে সংশোধনীর আবশ্যকতা রয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আসন্ন নির্বাচনের আগে এমন সংশোধনী এনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০ আসনের তিন ভাগের এক ভাগ আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠানে আগ্রহ ব্যক্ত করে আসছে এবং সে লক্ষ্যে নির্বাচনী আইনে সংশোধনী আনার বিষয়টি চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১০০টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট নিতে হলে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে ইভিএমের পরিবর্তে এ কাজ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিমানুষের শ্রমে নির্বাহ করা হলে ব্যয়ের পরিমাণ সে তুলনায় অতি নগণ্য হবে।
দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় বসবাস অযোগ্য শহর। বসবাস অযোগ্য প্রথম শহরের তালিকায় রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। দামেস্ক যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর না হলে ঢাকার স্থান যে প্রথম হতো তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যেসব কারণে ঢাকা দ্বিতীয় বসবাসের অযোগ্য শহর, এর অন্যতম হলো শহরটির যানজট। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে প্রতি বছর ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্যমান ৩০ হাজার কোটি টাকা।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিজ দেশের জন-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দেশের ভালো-মন্দ নিরূপণ করে থাকে। ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণ করা হলে ব্যালট হাতে গণনার পদ্ধতির চেয়ে চার থেকে ছয় ঘণ্টা আগে ভোটের ফলাফল জানা যায়। ভোট গ্রহণের পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, দেশবাসী নিশ্চিত হতে চায় ভোট প্রদান ও গণনায় যেন কোনো ধরনের কারচুপি না হয়। ভোট গ্রহণের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট এবং নেপথ্যে থেকে তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মধ্যে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে ভোট গ্রহণ পদ্ধতি ব্যালট নাকি ইভিএমেÑ প্রশ্নটি অবান্তর।
যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে নির্বাচন কমিশন ১০০টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে এর চার ভাগের এক ভাগেরও কম অর্থ ব্যয়ে ঢাকা শহরে ২০টি ইউলুপ নির্মাণ করা হলে নগর পরিকল্পনাবিদদের ধারণা শহরটির যানজটের বহুলাংশে লাঘব ঘটবে। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, আমাদের কাছে ইভিএমে ভোট গ্রহণ জরুরি নাকি ঢাকা শহরের যানজট নিরসন তার চেয়ে জরুরি? হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল