রোহিঙ্গা মুসলমানেরা মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে দলে দলে দুর্গম পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এক বছর হলো। এর মধ্যে নাফ নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাংলাদেশ সরকার যেমন তোষামোদ করেছে, তেমনি কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা চালিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগেরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি। রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণের দায়ে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশ মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির ‘নিদানকালে’ দেয়া কিছু অ্যাকাডেমিক সম্মাননা প্রত্যাহার করেছে। মনে হচ্ছে, অং সান সু চির এতে কিছু যায় আসে না। তিনি এখন মিয়ানমানের চরম ক্ষমতাবান কর্ণধার। তার পেছনে চীন, রাশিয়া ও বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সমর্থন নিরঙ্কুশ। সম্প্রতি কাঠমাণ্ডুতে যে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভুটান ও নেপালÑ এই সাত জাতির বিমসটেক সম্মেলন হয়ে গেল তাতে রোহিঙ্গা সমস্যাটি এত গুরুত্ববহ হলেও অনুচ্চারিতই রয়ে গেল। এ সমস্যা নিয়ে তাদের কেউ মাথা ঘামানোর দরকার মনে করেনি। চীন বলে দিয়েছে, চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা মুসলমান সমস্যার সমাধান হবে না।
সরকারের এই অন্ধ ভারতনীতি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অনেকটাই একঘরে করে ফেলেছে। আজ বিপদের দিনে বাংলাদেশের পাশে লিপসার্ভিস দেয়ার মতো লোক বা দেশ থাকলেও কার্যকর সাহায্য দেয়ার মতো কেউ নেই।
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চির দেয়া বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত নেবেন না। তিনি বলেছেন, এদের ফেরত দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। আমরা এতদিন বাংলাদেশের সরকারের নেতাদের মুখে শুনে এসেছি, রোহিঙ্গা মুসলমান সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এ সমস্যা তাদেরই সমাধান করতে হবে। কথাটা সত্য। তবুও মিয়ানমার নেত্রী এ দাবি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলটি বাংলাদেশের কোর্টে ছুড়ে দিলেন। বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুটি দ্বিপীয়ভাবে সমাধান করতে চেয়েছিল। সরকারের অবস্থান ছিল, কোনো রকমে রোহিঙ্গাদের বর্ডার পার করে মিয়ানমারে ঢুকিয়ে দেয়া।
মিয়ানমারের নাগরিকত্বহীনতার শর্তে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত দেয়া যায় না। নাগরিকত্ব পেলেও রোহিঙ্গা মুসলমানেরা মিয়ানমারে নিরাপদ থাকবে না, যেমন কাশ্মিরিরা ভারতে মোটেও নিরাপদ নয়। মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। বহু দেশ রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে লিপসার্ভিস সমর্থন দিলেও তারা এ প্রশ্নে বাংলাদেশকে কার্যকর কোনো সাহায্য দেবে না। রোহিঙ্গা মুসলমান প্রশ্নটি সম্পূর্ণ আলাদা। একে তো বর্তমান বিশ্বে মুসলমানেরা সর্বত্রই নিগৃহীত; তদুপরি মিয়ানমারের পশ্চিমা-নন্দিত নোবেল বিজয়ী ও পাশ্চাত্য শিায় শিতি নেত্রী সু চির আন্তর্জাতিক রাজনীতিক মহলে একটা পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। এর সমতুল্য পরিচিতি কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আছে? ‘রাজা পূজ্য স্বদেশেতে সর্বত্র বিদ্বান’। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবের কন্যা, এটা তার মর্যাদার কারণ হতে পারে কিন্তু যোগ্যতা নয়। যোগ্যতা বিষয়টা বহুলাংশেই নির্ভরশীল মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের গুণাবলির ওপর। রোহিঙ্গা প্রশ্নে সেটা তিনি পুরো প্রয়োগ করে দেখাতে পারেননি। বিষয়টাকে সেভাবেই আমদের দেখতে হবে যদি এ সমস্যার বাস্তবসম্মত একটি সমাধান আমরা চাই। আমাদের বুঝতে হবে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমার ওদের অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়নি। এরপরও মিয়ানমারের দেয়া মিথ্যা আশ্বাস বাংলাদেশ সরকার শিরোধার্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। একটি সরকার কতটা দিশেহারা হলে তা করতে পারে, সহজে অনুমেয়।
এমতাবস্থায় আমাদের সামনে দু’টি পথ খোলা আছে। প্রথমত সশস্ত্র সঙ্ঘাতে সফল হয়ে রাখাইন রাজ্যে সেখানকার ৭৪ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান অধিবাসীদের পুনর্বাসন করা। সেটি আমরা পারব না; বিশ্ব পরিস্থিতি এর অনুকূল নয়। বিদেশীরা বাংলাদেশকে মুখে প্রশংসা করে অনেক কিছুই বলেন এবং সরকার তাতে আহাদিত হয়। কিন্তু আসল কাজটি হয় না। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে রেখে বিদেশী করুণা ভিা না করে আমাদের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেয়া। যা হোক, সমস্যাটি জিইয়ে রাখলে বিশ্বের দরবারে আমরা হেয় প্রতিপন্ন হবো। রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেখতে বিভিন্ন অমুসলিম দেশ থেকে যারা আসেন, তারা আসেন সু চি মুসলমানদের কী দুর্দশায় ফেলতে পেরেছেন তা দেখতে। তারা নানা সহানুভূতির কথা বলে হেসে চলে যান। কিন্তু এটা বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা পরিশ্রম করে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করুক; সেটা রোহিঙ্গাদের জন্য কেবল নয়, মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্যও মর্যাদার। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেবে।
আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে সব পই নানা প্রশ্নে সরব; কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমান প্রশ্নে সব পই নীরব। নির্বাচনের আগেই এ ব্যাপারে সরকার প কী ভাবছে, সেটা স্পষ্ট করে বলা জরুরি। তেমনি বিরোধী দলের প থেকেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতি উচ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অথচ নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক পগুলো কেবল মতায় যাওয়ার কৌশল নিয়ে সোচ্চার এবং ব্যস্ত। তারা রোহিঙ্গা মুসলমান প্রশ্ন ও অন্যান্য জাতীয় ইস্যুর ব্যাপারে নিশ্চুপ। রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি গুরুতর সমস্যাকে সরকার বা বিরোধী, কোনো পই এড়িয়ে যেতে পারে না। এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলে এ সমস্যার কী বিহিত করা যায় সে ব্যাপারেও সোচ্চার হতে হবে দলগুলোকে। রোহিঙ্গা সমস্যা ঝুলিয়ে রাখা কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে বাংলাদেশের এ সমস্যার আশু সমাধান জরুরি। বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেলে দিতে আদৌ ইচ্ছুক নয়, তারা এ সমস্যার একটি সম্মানজনক আশু সমাধান যে চায়, তা দেশের রাজনীতিকদের উপলব্ধি করতে হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তের মুসলমানদের দুর্ভোগের মতো বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগও আমাদের পীড়া দেয়। এ সমস্যার শিগগিরই একটা মর্যাদাকর বিহিত করতেই হবে। এ চ্যালেঞ্জ সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে না পারলে সরকারকে ব্যর্থতার লজ্জাজনক কলঙ্ক মেনে নিতে হবে। হ
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা