২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের ১০ আহ্বান

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীর উদ্দেশে অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের বক্তব্য - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন।

বুধবার (৩১ মে) তিনি এই বক্তব্য প্রদান করেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমির আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশের এক কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা জানেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য পোষণ করে এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার জনগণের ওই দাবি বাস্তবায়নের পরিবর্তে হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দায়ের ও নেতাদের অন্যায়ভাবে আটক রেখে আবারো একতরফা নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য সমঝোতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা দখল করে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি এক প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত হয়। ১৫৪টি আসনে সরকারি দল ছাড়া অন্য কোনো দলের প্রার্থী ছিল না। ফলে ওই ১৫৪টি আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নিজেই উল্লেখ করেছিলেন, এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তিনি তার কথা রাখেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে ঘোষণা করলেও আগের রাতেই ব্যালট পেপার ছিনতাই করে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী করার ব্যবস্থা করা হয়। এটি মধ্য রাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।’

তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়েছে। প্রশাসনের পেশাদারিত্ব বলতে কিছুই নেই। দলীয় লোকদের দ্বারা প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে বিরোধী দলকে হয়রানি করা হচ্ছে। বিশেষ করে দলীয় ক্যাডারদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে অব্যাহতভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে।’

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২৪৬ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৮৬ জন নেতাকর্মীকে, গ্রেফতার করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৯১ হাজার ২৪৬ জন নেতাকর্মীকে, জামায়াতের মহিলা বিভাগের এক হাজার ৮৭ জন নারীকে গ্রেফতার করা হয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ১৭ হাজার ৪৬৩ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ৬৭৬ জন ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এ পর্যন্ত সরকার জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ হাজার ৩০৯টি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নয় হাজার ৫৮৪টি মামলা দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় ৭৫ হাজার ৩৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়। পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে পাঁচ হাজার ২০৪ জন নেতাকর্মীকে পঙ্গু করে দেয়া হয়। ৯৬ হাজার ৯৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। গুম ও অপহরণ করা হয়েছে ২৫ জন নেতাকর্মীকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে পাঁচ হাজারেরও বেশি বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েও জামায়াতে ইসলামী গঠনতন্ত্রে বর্ণিত নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে তার দলীয় তৎপরতা চালিয়েছে এবং দেশের সামগ্রিক কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘এই সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ মিছিল-সভা সমাবেশ করার অধিকার রাখা হয়েছে। সংবিধান স্বীকৃত এই অধিকার বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব। পুলিশের কাছে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ বাস্তবায়নে সহযোগিতা ও অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হলে উল্টা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ২৮ মে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে অনলাইনে ৫ জুন সমাবেশের জন্য আবেদন করে। ২৯ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের চারজন আইনজীবীর একটি প্রতিনিধি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, নেতাদের মুক্তি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ৫ জুন সমাবেশ করার আবেদন নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের নিকট গেলে কমিশনার কার্যালয়ের গেট থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিসসহ দেশের বেশিরভাগ জেলা ও মহানগরী অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে জনগণের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে এবং সাংবাদিকদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে। ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভি, চ্যানেল ওয়ান, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক দিনকালসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, জাতীয় দৈনিক এবং বহু অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার তদন্তের প্রতিবেদন পেশ ধার্য তারিখ ৯৮ বার পরিবর্তন করা হয়েছে।’

জামায়াত নেতা বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর যাবত দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। বর্তমান সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে কেউ বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না, নির্বাচন করতে পারবে না, সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতে পারবে না। এমনকি অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে কোনো কথাও বলতে পারবে না। সরকার মূলত বাংলাদেশকে একটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দেশের মানুষের দৃষ্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এই সরকারকে বিতাড়িত করে তাদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। কিন্তু সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মত একটি নির্বাচন করার নীল নকশা প্রণয়ন করে আবারো ক্ষমতায় বসার পরিকল্পনা করেছে। সরকারের ব্যর্থতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতিকে ধ্বংস করায় বাংলাদেশকে মার্কিন ভিসা নীতির শিকার হতে হয়েছে। এ কলঙ্ক বাংলাদেশের জনগণের নয়, বর্তমান সরকারের।’

তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারা নিশ্চিত করাতে জামায়াতে ইসলামী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে তিনি আহ্বান জানান-

১। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

২। অবিলম্বে আটক জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীসহ সকল নেতাকর্মী ও আলেম-উলামাকে মুক্তি দিতে হবে।

৩। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর মুক্তি না দিয়ে জেলখানায় আটক রাখার বেআইনী, অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে আটক নেতাদের মুক্তির পরিবর্তে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা ও বন্দি থাকাবস্থায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।

৪। অবিলম্বে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ জেলা ও মহানগরীর সকল কার্যালয় খুলে দিতে হবে।

৫। সংবিধান স্বীকৃত মিটিং-মিছিল ও সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৬। সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমান আহমদ বিন কাসেম, হাফেজ জাকির হোসাইন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও মোহাম্মদ ওলিউল্লাহসহ নিখোঁজ ব্যক্তিদেরকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

৭। সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৮। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় আনতে হবে।

৯। বিদেশে পাচার হওয়া সকল অর্থ ফেরত এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১০। বন্ধ সকল চ্যানেল, জাতীয় দৈনিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু ও সাংবাদিক দমনপীড়ন বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘দেশের সঙ্কট নিরসনে জনগণকে সাথে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আপনাদের সাথে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমিন।’

প্রেস বিজ্ঞপ্তি


আরো সংবাদ



premium cement