১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


সরকারি চাকরি বিল : দুর্নীতি ও অনিয়ম আরো ‘বিকশিত’ হওয়ার আশঙ্কা

সরকারি চাকরি বিল : দুর্নীতি ও অনিয়ম আরো ‘বিকশিত’ হওয়ার আশঙ্কা। - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কোনো ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না। এমন বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল ২০২৩’ পাস হয়েছে। বিষয়টিকে সংবিধান পরিপন্থী হিসেবে বর্ণনা করে এর সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষকরা।

বিলের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে।’

এই বিধান স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

এখানে ফৌজদারি মামলা বলতে ওই সব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করবেন তাদের বিরুদ্ধে আনা ‘দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত’ অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলার কথা বলা হয়েছে।

যা দুর্নীতি বা দায়িত্বে অবহেলার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা।

তবে এই ধারা দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, কারণ এটি বিশেষ আইন বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০১৩ সালের ৩২ (ক) ধারা অনুযায়ী, কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগত। পরে এই ধারাটি হাইকোর্টে বাতিল হয়ে যায়।

এর মধ্যে ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন হলো। সেখানও একই বিধান যুক্ত করা হয়।

তবে এতে দুদক কোনো বাধা পাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এপ্রিল মাসে দুদক একজন উপ কর কমিশনারকে গ্রেফতার করেছে। তখন ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ধারা বহাল ছিল। কিন্তু তাকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে দুদককে কোনো বাধা দেয়া হয়নি।’

সরকারি চাকরির এই ধারাটি নিয়ে দীর্ঘ দিনের বিতর্ক রয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামালার কার্যক্রম পরিচালনায় সময়ক্ষেপণের জন্য এই ধারাটিকে দায়ী করা হয়।

এই ধারার কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলাজনিত মামলায় তদন্তে দেরি হয়। ফলে আইনের ফাঁক গলে প্রকৃত অপরাধীদের পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিলটি আইনের চোখে সবাই সমান-এই নীতির পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন বিরোধী নেতারা।

বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান মিজবাহ বলেছেন, এ আইন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের অভিযোগ গ্রহণের আগে গ্রেফতার করা যাবে না, এটা আইনের চোখে সবাই সমান- এ নীতির পরিপন্থী।

বিলটিকে বৈষম্যমূলক ওর সংবিধান পরিপন্থী উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, সেখানে এই বিল পাসের মাধ্যমে একটি বিশেষ শ্রেণিকে বা যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে সুরক্ষা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

এর ফলে দুর্নীতি ও অনিয়ম আরো বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এই সংবিধান পরিপন্থী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুবিধা প্রদান করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে তিনি জানান।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি একাধিকবার আদালত কর্তৃক বাতিল হয়েছে। সংসদে উত্থাপন হলেও এটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। আইন হতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর লাগবে। তাই সরকারের উচিত হবে আইন পাসের আগে বিলটি আবারো বিবেচনা করা।’

এই বিল পাসের মাধ্যমে দুর্নীতিকে উস্কে দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক সচিব ফওজুল কবির খান।

তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরি তো কোনো পৈত্রিক ব্যবসা না। এর ভিত্তি হচ্ছে জবাবদিহিতা। সরকারি কর্মকর্তাদের এখনই কোনো জবাবদিহিতা নেই। এই বিল পাসের ফলে আরো থাকবে না। কেউ সরকারের প্রতি অনুগত থাকলে তাকে গ্রেফতারের অনুমতি দেয়া হবে না। এতে দুর্নীতির যে ব্যাপকতা সেটা আরো সর্বগ্রাসী হয়ে যাবে।’

এছাড়া সব নাগরিককে সমান চোখে দেখার যে সাংবিধানিক মূলনীতি তা এই আইনের ধারার সাথে সাংঘর্ষিক বলে তিনি মনে করেন।

তবে এই ধারার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন গত বছর বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের হয়রানি করার জন্য অনেকে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। মামলা দায়ের হওয়ার সাথে সাথে যদি তাদেরকে গ্রেফতার করা হয় দেখা যায় পরে মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং তিনি খালাস পেয়ে বের হয়ে আসে।’

তিন বলেন, ‘এই যে মাঝখানের ভোগান্তি, নিরসন করার জন্য ও সরকারি কাজের সুবিধার জন্য বিধানটি করা হয়েছে। সবাই কিন্তু সমান হবে না। এখানে জনগণ একটা ক্লাস, সরকারি কর্মচারীরা একটা ক্লাস। তাই এখানে সংবিধানের ব্যত্যয় হয়নি।’

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, একজন সরকারি কর্মকর্তার পেশাগত নিরাপত্তা বেশি জরুরি নাকি দেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা জরুরি। কোনো বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়ার কথা?

তবে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের পর তিনি যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি জানান, সেটা না করে ন্যায় বিচারকে ব্যাহত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

গত বছর সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ সালের ৪১ (১) ধারা, যেখানে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থা।

সংস্থাটির পক্ষে জনস্বার্থে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৪১ (১) ধারা কেন বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না এবং ধারাটি কেন সংবিধানের ২৬ (১) (২), ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।

উল্লেখ্য, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সংবিধানের ২৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল হবে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো আইন যতখানি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকু বাতিল হবে।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলো বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট গত বছরের ২৫ আগস্টে এই বিধানটি বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ সরকারের অনুমতি ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করতে পারবে বলে হাইকোর্ট রায় দেয়।

আদালত জানায়, সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারে পূর্বানুমতির বিধান বেআইনি, সংবিধান ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী।

তবে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করলে রায় স্থগিত করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিষয়ে করা আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে বলে আপিল বিভাগ আদেশ দেন। অর্থাৎ বিষয়টি এখনো দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

বিষয়টি নিষ্পত্তির আগেই সংসদে বিল আনার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেছেন খুরশীদ আলম খান।

তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি হয়নি। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এ ধরনের বিল সংসদে উত্থাপন করা বা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া সাংবিধানিকভাবে বৈধ নয়।

পরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির সংশোধিত খসড়া অনুমোদন পায়।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
গাজীপুরে কারখানার ছাদ থেকে পড়ে পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন : বাইডেনকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বগুড়ায় তীব্র লোড শেডিং, ২২ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ গণ-অর্থায়নের মাধ্যমে যেভাবে এভারেস্টের চূড়ায় বাবর আলী ৩২ দিনে ৮ বার বাড়ল স্বর্ণের দাম ইরানি প্রেসিডেন্ট ওই হেলিকপ্টারে ছিলেন না! সফলতার সাথে আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি : মেয়র তাপস সৌদির ঐতিহাসিক যে স্থানটিতে ৭ দেশের হাজিরা তাবু স্থাপন করতো ঈশ্বরদীতে ২৯৫ বোতল ফেন্সিডিলসহ রেলওয়ে সিপাহি আটক গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক সেনাসহ নিহত ২, চালক আটক আশুলিয়ায় ৫০ লিটার মদ নিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীসহ আটক ২

সকল