হজরত মোহাম্মদ সা: তার বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, তোমাদের পথপ্রদর্শন হিসেবে দু’টি বস্তু আমি রেখে যাচ্ছি। এক আল্লাহর বাণী অর্থাৎ কুরআন। দুই, তাঁর রাসূলের জীবনাদর্শ। তোমরা এই দু’টিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকলে তোমাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
কুরাইশ বংশের হাশেমী ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে যুগ যুগ ধরে দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি ছিল। তাই হজরত আলীর খিলাফত লাভ উমাইয়াগণ সহ্য করতে পারছিলেন না। হজরত উসমানের নিযুক্ত বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের বিরুদ্ধে নানাজাতীয় দুর্নীতির অভিযোগের ফলে আলী তাদের পদচ্যুত করে নতুন গভর্নর নিয়োগ করেন। কিন্তু একজন গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ না করে খলিফার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে অগ্রসর হন।
তার ধৃষ্টতা ও অবাধ্যতার ফলে ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হজরত আলী পঞ্চাশ হাজার সৈন্যসহ সিফফিন নামক স্থানে উপস্থিত হন। শান্তির দূত হজরত আলী শান্তির প্রস্তাব পাঠিয়ে মুয়াবিয়াকে ইসলামের স্বার্থে বশ্যতা স্বীকার করার পরামর্শ দেন। বিপরীত পক্ষের ঔদ্ধত্য ও জঙ্গি মনোভাবের পরিবর্তন হলো না। খিলাফতের উত্তরাধিকার নিষ্পত্তি করার জন্য ওই গভর্নরকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানান। কিন্তু ধূর্ত গভর্নর তাতে রাজি হলেন না। এক পর্যায়ে শুরু হল চক্রান্ত। বর্শা ও পতাকার সাথে কুরআন বেঁধে চিৎকার করে অগ্রবর্তী সৈন্যদল আশ্রয় প্রার্থনা করে। হজরত আলী অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর চাপে যুদ্ধ বন্ধ করেন।
এরপর মীমাংসার জন্য দু’দলের মধ্য থেকে একজন করে সালিস বা মধ্যস্থ ব্যক্তি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সালিসের মধ্যে এক পক্ষের শঠতার জন্য হজরত আলীর পরাজয় ঘটে। এমনকি একদল মুসলমান এই জাতীয় সালিস মীমাংসার প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ অনৈসলামী বলে দলত্যাগ করে। যাদের ইতিহাসে খারিজি সম্প্রদায় বলা হয়। তারা ঘোষণা করে, আল্লাহ ভিন্ন কারো মীমাংসার অধিকার নাই।
খেলাফতের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ ও অশান্তি দেখা দিলে হজরত আলী বাধ্য হয়ে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি করতে সম্মত হন। সন্ধিতে সিরিয়া ও মিসরে মুয়াবিয়ার শাসন ও অবশিষ্টাংশে আলীর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিদ্রোহী খারিজিগণ আলী, মুয়াবিয়া, আমর ইবনুল আসকে মুসলিম সমাজের শত্রু বলে দায়ী করে এবং হত্যার ষড়যন্ত্র করে। হজরত আলী ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং শাহাদত বরণ করেন।
আলীর পুত্র ইমাম হোসাইন, ইয়াজিদকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নেননি। তিনি ছিলেন ইয়াজিদের তুলনায় এর অধিক হকদার। মক্কা ও মদিনার মুসলমানগণ নবীর দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের সমর্থক ছিলেন। ফলে খেলাফতের দাবির প্রশ্নের ফয়সালার জন্য যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কুফাবাসীগণ ইমাম হোসেনের সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা ইমামকে খেলাফতের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু কুফাবাসীদের এই আশ্বাস ছিল ক্ষণস্থায়ী। তবুও কুফাবাসী ও আবদুল্লাহ ইবনে হোসেন কুফার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চাচাতো ভাই মুসলিম কুফাবাসীদের কাছ থেকে সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হোসেনকে কুফায় আসতে অনুরোধ জানান। পথিমধ্যে ইরাকের শাসনকর্তা ইমামের সমর্থক লোকজনকে হত্যা করে। ভীত কুফাবাসী আর হোসেনের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
কুফাবাসীদের সাহায্যের ওপর ভরসা করে আর মুসলিমের আশ্বাস সংবলিত পত্র পেয়ে ইমাম হোসেন সপরিবারে মদিনা ছেড়ে পিতার গড়া রাজধানী কুফার দিকে রওনা হন। পথে মুসলিম হত্যার খবর পেয়ে ইমাম ব্যথিত হন। ক্রমাগত শুধু দুঃসংবাদ আসতে থাকে। শত্রুদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে ইমাম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ১ মহররম শিবির স্থাপন করেন। ইমাম হোসেনকে এজিদের নামে আনুগত্যের শপথ নিতে বলেন। হোসেন তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তার সৈন্যগণ ইমামের তাঁবু ঘিরে ফেলে এবং ফোরাতের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এ দুরবস্থায় তিনি তিনটি প্রস্তাব পাঠান।
(১) তাঁকে মদিনায় সপরিবারে ফিরতে দেয়া হোক অথবা (২) তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক। অথবা (৩) এজিদের সাথে আলোচনা করার জন্য দামেস্কে পাঠানো হোক। জনৈক সীমারের প্ররোচনায় হোসেনের প্রস্তাবে তারা রাজি হলেন না। পানির অভাবে ইমাম শিবিরে হাহাকার পড়ে গেল। ছোট শিশুরা পানির পিপাসায় মূর্ছিত হতে লাগল।
অবশেষে ইমাম বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ‘সঙ্গী সাথীরা নবীর স্নেহধন্য হোসেনকে রেখে পালাতে রাজি হলেন না। তাদের কাছে তার চেয়ে মৃত্যুই যে শ্রেয়। এমনকি শত্রু পক্ষের ত্রিশজন অনুচর প্রিয় নবীর দৌহিত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরাকে পাপ মনে করে ইমাম পক্ষে যোগ দিলেন।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর (১০ মহররম) নগণ্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ ইমাম শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। প্রিয় পুত্র কাশেম শত্রুর আঘাতে শাহাদত বরণ করলেন। প্রচণ্ড সংঘর্ষে একে একে সবাই শাহাদতের পেয়ালা পান করতে লাগলেন। শিশুপুত্র আসগরকে শত্রুরা তীরবিদ্ধ করে পিতার কোলে নিহত করল।
ইমাম শত্রুবাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আল্লাহর দরবারে শেষ মোনাজাত করে মরিয়া হয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শত্রুরা ভীত হয়ে পালাতে থাকে। কিন্তু একটু পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইমাম মূর্ছিত হয়ে পড়েন। ঘাতক সীমার পাশবিক বর্বরতার সাথে প্রিয় নবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের প্রতি চরম অসম্মান দেখিয়ে মস্তক ছিন্ন করল। ঐতিহাসিক গিবন বলেন, ‘হুসাইনের মৃত্যুর হৃদয়বিদারক দৃশ্য নিতান্ত নিরাসক্ত পাঠকেরও সহানুভূতির উদ্রেক করিবে।’
সত্য ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ইমাম হোসেন জালেম, স্বৈরাচার শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি জীবনদান করে বিশ্বের কাছে এক মহান শিক্ষার উৎস রেখে গেলেন। এজিদের আনুগত্য স্বীকার করে নিলে নিজেরসহ আত্মীয়স্বজনের জীবন রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তার মহান আদর্শ ও নীতিতে অবিচল ও অটল থেকে সত্যের জন্য জীবন দিলেন।
কারবালার মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলমানদের এই শিক্ষা দেয় মুসলমানরা আজ আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, বাহ্মণ্যবাদ ও বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজন হলে সংগ্রাম করতে পারে। আজ ফিলিস্তিনের লাখ লাখ মুসলমানরা সেই অনুপ্রেরণায় স্বদেশের জন্য, মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধরত। আজ নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের। কাশ্মিরে লাখ লাখ মুসলিম আজো স্বাধিকার ও স্বাধীনতা পাচ্ছেন না। মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এটাই হলো তাদের অপরাধ। আল্লামা ইকবালের ভাষায় : ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কার বালা কি বাদ।’
ইসলাম কারবালা প্রান্তরেই শেষ হয়ে যায়নি। ইসলাম যুগে যুগে টিকে থাকবে। আজ পৃথিবীর হতাশাগ্রস্ত মানুষকে সমাজবাদ নয়, পুঁজিবাদ নয় ইসলামই একমাত্র শান্তি দিতে পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা