১৫ মে ২০২৪, ০১ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫
`


ইমরানের হতবাক করা ইনস্যুইংয়ে বিধ্বস্ত পিডিএম

ইমরান খান। - ফাইল ছবি

পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআইয়ের অভাবিত বিজয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ নির্বাচন একদিকে পাঞ্জাবে চিফ মিনিস্টার হিসেবে হামজা শাহবাজের উৎখাতের ফায়সালা হয়েছে; অন্যদিকে কেন্দ্রে পিতা শাহবাজ শরিফের ১৩ দলীয় পিডিএম সরকারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পাল্টে দিয়েছে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী সামন্ত এলিটদের হিসাব-নিকাশও। এ যেন ইমরান খানের হতবাক করা ইনস্যুইং, যা পিডিএমের সব ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

এটি উপনির্বাচন হলেও পাকিস্তানের টালমাটাল রাজনীতিতে খুবই গুরুত্ববহ। প্রথমত, পাঞ্জাবের মতো জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ যেখানে অনেক বছর ধরে নওয়াজ মুসলিম লিগ আধিপত্য দেখিয়ে আসছে সেখানে দলটির এই শোচনীয় পরাজয় প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহেরই নামান্তর। পিপিপি সিনেটর মোস্তফা নওয়াজ খোকার এই ফলাফলকে জোট সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অনাস্থা প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি অশাসনযোগ্য শাসন করার পরিবর্তে অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, যেভাবে আমেরিকার মদদে সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও পিডিএমের যৌথ পরিকল্পনা ও প্রযোজনায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে ইমরান খান সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল তা জনগণ যে মেনে নেয়নি, তা এই রায়ে প্রতিভাত হয়েছে।

তৃতীয়ত, পিটিআইয়ের পক্ষে এই বিপুল রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, ১৩ দলের তথা শাহবাজ সরকারকে ভোটাররা ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এটি শাহবাজ সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত একটি গণরায়।

চতুর্থত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে পিডিএম ইমরান খানের দলের বিজয়কে কলঙ্কিত করার চেষ্টা যে করেছিল তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বরং ওই নির্বাচনে পাঞ্জাবে নওয়াজ মুসলিম লিগ কী ধরনের কারচুপি করেছিল সে প্রশ্ন জোরেশোরে উঠে এসেছে।

পঞ্চমত, পিটিআইয়ের এই ভ‚মিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে মূলত পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এত দিন ধরে নওয়াজ শরিফ ও জারদারি পরিবার ভেবে আসছিল যে, পাকিস্তানের তালুকদারি পর্যায়ক্রমিক এই দুই পরিবারে আবদ্ধ।

ষষ্ঠত, সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে, এই উপনির্বাচনের ফলাফল সামন্তবাদী রাজনৈতিক আভিজাত্যে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। বিগত ৭৫ বছর ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক ও বেসামরিক লেবাসে সামন্ত প্রভুরাই শাসন করে আসছে। এই প্রথম ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি দল শহরের মধ্যবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী জাতীয় নির্বাচন যদি ঠিকমতো অনুষ্ঠিত হয়; তাহলে ইমরান খানের দল দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি লাভ করতে পারে যা পাকিস্তানে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেবে। এতে কায়েমি স্বার্থের যুথবদ্ধ চক্র ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। যদিও সেটা এত সহজ কাজ হবে না।

সপ্তম, পাঞ্জাবের এই উপনির্বাচনে ২০টি আসনের মধ্যে পিটিআই ১৫টি আসনে জয়লাভ করেছে। চারটিতে নওয়াজ মুসলিম লিগ, একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী। বিশেষ করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাহোরের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই পিটিআই জিতেছে। একটিতে নওয়াজ মুসলিম লীগ। এ আসনগুলো মূলত নওয়াজ মুসলিম লিগের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত। আর সে জন্যই এই উপনির্বানের ফলাফল এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং যা ক্ষমতাসীন পিডিএম জোটকে হতবাক করে দিয়েছে। তা ছাড়া পাঞ্জাবের রাজনৈতিক ইতিহাসে পিটিআই প্রথম বিরোধী দল হিসেবে উপনির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। এর আগে আর কোনো বিরোধী দল বিজয়ী হয়নি।

অষ্টম, পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও পিডিএম নেতারা যে, একটি ভুল হিসাব-নিকাশ করে ইমরান খান সরকারকে উৎখাত করেছিল তা এই উপনির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। তারা ভেবেছিল ইমরান খান জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার শাসনে জনগণ বিক্ষুব্ধ। সুতরাং তাকে উৎখাত করলে জনগণ তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কিন্তু ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। উল্টো ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হয়েছে। তার ডাকে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে তা রাত কিংবা দিনে। পক্ষান্তরে সব ধরনের সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করেও নওয়াজ মুসলিম লিগ কিংবা পিডিএমের জনসভায় লোক সমাগম করা দুষ্কর হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি, রুপির মান হ্রাস, তেল-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ভুল বিদেশনীতি ইত্যাদি অভিযোগ তুলে যে ব্যর্থতার দায় ইমরান খানের ঘাড়ে চাপিয়ে পিডিএম হইচই ফেলেছিল তা শাহবাজ শরিফের কয়েক মাসের শাসনে প্রমাণ হয়েছে- ওইসব অভিযোগ কতটা অন্তঃসারশূন্য ছিল। বরং শাহবাজ শরিফ অল্প সময়েই প্রমাণ করেছেন তিনি কতটা ব্যর্থ। এখন বলা হচ্ছে, পাকিস্তান দেউলিয়ার পথে। আর এ সবেরই প্রতিফলন ঘটেছে উপনির্বাচনে।

নবম, এই ফলাফলে পাঞ্জাবে হামজা শাহবাজের গদি উল্টে যাবে। কারণ সংখ্যার হিসাবে পিডিএমসহ মুসলিম লিগের (এন) হাতে আছে নতুন নির্বাচিত চারজনসহ ১৭৯ এমপিএ। আর নতুন নর্বাচিত ১৫ জনসহ পিটিআই ও তার জোটের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮৮। দরকার ১৮৬ জনের সমর্থন। এখন পিডিএম জোট যদি পিটিআই জোট থেকে সাতজন ভাগাতে পারে তাহলেই কেবল হামজা শাহবাজ চিফ মিনিস্টার হিসেবে থাকবে। তা না হলে তাকে বিদায় নিতে হবে। কোর্টের রায় অনুযায়ী ২২ জুলাই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

দশম, এখন পিটিআই জোট পাঞ্জাবে সরকার গঠনের পর ইমরান খান যদি পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুন অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেন এবং বেলুচিস্তানেও যদি একই ঘটনা ঘটে; তাহলে শুধু বাকি থাকবে সিন্ধুতে পিপিপি সরকার। এ অবস্থায় জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন দেয়া ছাড়া শাহবাজ সরকারের আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে পাকিস্তানের অনেক বিশেষজ্ঞ এটাও মনে করেন, ইমরান খান সব টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেবেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি চাপ প্রয়োগ করতে থাকবেন অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণার জন্য। ইতোমধ্যে তিনি সে চাপ দেয়া শুরু করেছেন। সম্ভবত ইমরান খানের লক্ষ্য হচ্ছে, নভেম্বরেই নির্বাচন সম্পন্ন করা।

পরিশেষে এটি বলা যায়, পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী এলিট শ্রেণী পছন্দ করুক বা না করুক জুলফিকার আলী ভুট্টোর পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৭০ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঠিক এভাবেই ইমার্জ করেছিলেন। তার বিশাল জনপ্রিয়তার ফলে তখনকার প্রশাসন কার্যত তার হাতে চলে গিয়েছিল। তখন জেনারেলরাও তার কথায় উঠবস শুরু করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবেই ইমরান খানের উত্থান ঘটেছে। এখন দেখা যাক মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

তবে পাঞ্জাব উপনির্বাচনের ফলাফলের পর এখন ধারণা করা যায়, পাকসেনা নেতৃত্বের মনে যাই থাকুক না কেন, এখন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথেই তাদের হাঁটতে হবে। এ ছাড়া পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। যদিও নওয়াজ মুসলিম লিগ ও পিপিপি নেতারা তাদের পরানো ‘ইগোর’ পথই বেছে নিয়েছেন। তারা নির্বাচনের পরের দিন অনুষ্ঠিত জোটের বৈঠকে মেয়াদ পূর্ণ করে আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার কোনো কোনো নেতা বলেছেন, পিটিআই যদি পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুন অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয় তাহলে অবিলম্বে নতুন নির্বাচন হতে পারে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পাঞ্জাবে শোচনীয় পরাজয়ের পর পিডিএম সরকার ইমরান খানকে মোকাবেলা করতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের ভেতরে শুরু হয়েছে টানাপড়েন। কিন্তু তারা তাদের ঐতিহ্যগত মৌরসিপাট্টার একগুঁয়েমিপনার পথই অনুসরণ করছে, যা অনিবার্যভাবে পরাজয়ের পথ।


আরো সংবাদ



premium cement
অলরাউন্ডার তালিকায় যৌথভাবে শীর্ষে সাকিব ও হাসারাঙ্গা ‘ব্যাংক খাতে আড়তদার তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক’ রাজশাহীতে বাগান থেকে গুটি আম নামানো শুরু রাজশাহীতে সেলসম্যানকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে ২ জনের মৃত্যুদণ্ড জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি হ্রাস করেছে : প্রধানমন্ত্রী কুষ্টিয়াতে গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ কুলাউড়ায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষ, নিহত ১ রফতানি নীতিমালার খসড়া নীতিগত অনুমোদন ঈদের সরকারি ছুটি শুরুর আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়ার সিদ্ধান্ত ইটালিতে ১০৯ মাফিয়া সদস্য গ্রেফতার ফ্রান্সে হলোকস্ট মেমোরিয়ালে হামলা, মাক্রোঁর তীব্র সমালোচনা

সকল