২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


কোথায় হারাল সেই দিন

-

‘শৈশবে জ্ঞান অর্জন করা পাথরে কারুকার্য খচিত করার মতো। আর বৃদ্ধকালে ইলম অর্জন পানির ওপর লেখার মতো’ (তিরমিজি)। সন্তানের ইলম অর্জনে বাবা-মাা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যত্নবান হওয়া খুবই আবশ্যক। কারণ আজকে সে যদি সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারি, আগামী দিনে সে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে। তার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে। সমাজকে কল্যাণমূলক কিছু দিতে পারবে। আপনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, পাণ্ডিত্বের খ্যাতি রয়েছে আপনার, কিন্তু আপনি তা যোগ্য ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে পারছেন না, এ জ্ঞান ভবিষ্যতে আপনার কোনো উপকারে আসবে না। আপনি হয়তো জানেন, ‘...সম্পদের খেয়ানতের চেয়ে ইলমের খেয়ানত অনেক ক্ষতিকর। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে (বান্দাকে) জিজ্ঞাস করবেন (মুসলিম)।’

আপনি জ্ঞান অর্জন করছেন, এ জ্ঞান থেকে নিজে উপকৃত হতে চান, অন্যকেও এর ফায়দা দিতে চান, তাহলে নিজের নিয়তকে সহিহ করুন। লোভকে সংবরণ করতে শিখুন। কারণ জ্ঞান কখনো এই হীন মানসিকতা প্রশ্রয় দেয় না। জ্ঞান হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক বিশেষ নিয়ামত, যা আল্লাহ কোনো পাপী ব্যক্তিকে দান করেন না। তাই ইলমের দাবি- তা অর্জনের সাথে নিজ জীবনে এর বাস্তবায়ন। আর এটিই ইলম হাসিলের মূল উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করে আল্লাহ তার ইলমে বরকত দান করেন। তাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেন।

আপনি ইসলামী জ্ঞানী অবশ্যই পারদর্শী হবেন। অন্য দিকে যুগের ভালো মানুষ হিসেবে আপনাকে পরিগণিত হতে হবে। আর আপনাকে এটি বানিয়ে দেবে আপনার জ্ঞান। আপনার আমল। পার্থিব জ্ঞানকে আপনি কখনো দূরে ঠেলে দেবেন না। তাহলে আপনি যুগের অবহেলিত মানুষ হিসেবে পরিণত হবেন। মানুষ আপনার দিকে বিদ্রূপের তীর ছুড়ে মারবে। ভ্রু কুঁচকে ছোট করার চেষ্টা করবে।বিজ্ঞানময় কুরআনের অনুসারী মানুষগুলো কখনো তা হতে পারে না। ইলমের অধিকারী কোনো মানুষ কখনো বঞ্চনার জীবন বেছে নেয় না। তবে তারা ত্যাগী হতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা চিকিৎসা শাস্ত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে যে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছে, বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে তা দেখেছে। এভাবেই মুসলমান মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে।

আপনি জ্ঞানকে সদকা বানিয়ে দিন। জ্ঞানকে খুব বেশি বস্তুতান্ত্রিক করে তুলবেন না। যেটুকু নিতান্ত না করলে নয়, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকুন। জ্ঞানের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করুন। অকাতরে মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিন। মনীষীদের জীবন থেকে নিজের জীবনে সান্ত¡না দিন, অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন না। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতে অভ্যস্ত হন। তাহলে বাঁচার জন্য বেশি চিন্তিত হবেন না। জীবনকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন।

অগাধ সম্পদ অর্জন করার সমূহ পথ উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও একটি সহজ সরল ও স্বাভাবিক জীবন নিয়ে নিজেকে সান্ত¡না দিতে পারবেন। যে জীবনে বিরাজ করবে আল্লাহর ভয়। রাসূল সা:-এর মহব্বত। ইমামে আজম হজরত আবু হানিফা রহ: একজন সামান্য কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। চাইলে তিনি তার ইলমের বিনিময়ে অনেক কিছু অর্জন করে নিতে পারতেন। তিনি তা না করে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে দ্বীনের খিদমত করেছেন। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর পথে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্রাট হয়েও কুরআনের লিপিকর্মের দ্বারা অর্জিত পারিশ্রমিক দিয়ে সাংসারিক প্রয়োজন মেটাতেন। সম্রাট নাসির উদ্দীন টুপি সেলাই করে নিজের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করতেন। তারা সবাই জীবনকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন সেখানে মানুষের তরে নিজের জীবনকে বিলিয়ে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন।

এখন মানুষ বড়ই অস্থির। অল্পতে তুষ্ট হতে চায় না। সহজে অন্তরে প্রশান্তি আসে না। মানুষ মানুষের প্রতি সম্মানবোধ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। আপনি যার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করলেন, তার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা থাকতে হবে। অন্যদিকে যে আপনাকে জ্ঞান দান করলেন তাকেও অনেক উদার হতে হবে। তাহলে জ্ঞানের পারস্পরিক বিনিময় হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। একে অপরের প্রতি অনুভব করবে গভীর শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।

ইমাম আবু হানিফা রহ: জীবনে কোনো দিন তার ওস্তাদের বাড়ির দিকে পা ছড়িয়ে বসেননি। শুধু তাই নয়, যত দিন তার ওস্তাদ জীবিত ছিলেন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেননি। কারণ তার ভয় ছিল, তিনি যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেন- তাহলে হয়তো তার ওস্তাদের শাগরিদরা তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তি হবে। আর তিনি তার ওস্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাবেন যা তিনি কখনো আশা করেন না।

আজকে শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের সম্মান দেখে অবাক হতে হয়। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালি সুদিন? কোথায় যে বিলীন হলো শিক্ষাগুরুর মর্যাদা! ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ শিরোনামে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত সেই কবিতাটি বড্ড মনে পড়ে এখন। যে কবি নিজেও একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। সে তো বেশি দিনের কথা নয়। বাদশাহ আলমগীর মোগল সম্রাট। তার পুত্রকে পড়ানোর দায়িত্ব ছিল এক মৌলভীর। একদিন বাদশাহ দেখতে চাইলেন পুত্র কেমন শিক্ষা লাভ করছে তার ওস্তাদের কাছে। তাই নিজেই দেখতে বের হলেন। দেখলেন, ছেলে তার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। আর শিক্ষক তার পা নিজ হাতে ধুয়ে মুছে সাফ করছেন। বাদশাহর বিষয়টি মনঃপূত হলো না। ওদিকে বাদশাহকে দেখে শিক্ষক ভাবলেন, বাদশাহর ছেলের হাতে সেবা নিয়েছি আমি। আজ আর নিস্তার নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই শিক্ষকের মনে হলো- ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার/দিল্লির পতি সে তো কোন ছার/ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল/বাদশাহ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।’ শিক্ষক প্রকৃত অর্থে মনে মনে যা ভাবছিলেন, বাদশাহর চিন্তা অনুরূপ ছিল না। পুত্র কেবলি যে শিক্ষাগুরুর চরণে পানি ঢেলে দিচ্ছে, নিজ হাতে তা ধুয়ে দেয়নি তা দেখে বাদশাহ কষ্ট পেলেন। বাদশাহর এই আচরণে শিক্ষকের মন আনন্দে ভরে গেল। শিক্ষক তখন উচ্ছ্বাসভরে বললেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

লেখক : শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement