০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি

- ছবি : সংগৃহীত

সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল প্রচলিত একটি মতবাদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও এই মতবাদ নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অন্য দেশের চেয়ে একটু বেশি মাত্রায়ই হয়ে থাকে। এই মতবাদের মূল কথা হলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান হবে ধর্মের বিধিবিধানমুক্ত। ধর্মের ব্যবহার থাকবে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে।

ইংরেজি সেক্যুলার শব্দের অর্থ - পার্থিব; ইহজাগতিক; জড়জাগতিক বা লোকায়ত। সেই অর্থে সেক্যুলারিজমের অর্থ হচ্ছে - ইহজাগতিকতা বা ইহবাদ যার মূল বাণী হচ্ছে নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। আমাদের পণ্ডিতরা অত্যন্ত সুকৌশলে সেক্যুলারিজমের অর্থ ইহজাগতিকতা বা ইহবাদের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বানিয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দেয়ার হীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আর ইহজাগতিকতা বা ইহবাদের অর্থ এক নয়। ধর্মের ব্যাপারে যাদের বিতৃষ্ণা আছে তাদের কাছে এ শব্দটি প্রাসঙ্গিক; কারণ এ শব্দের মধ্যে একটা আর্ট আছে, আছে লুকোচুরি খেলার মতো একটা ক্ষেত্রও।

সেক্যুলারিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে মূলত রাজা ও চার্চের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। চার্চের ধর্মযাজকরা রাষ্ট্রের জনগণ এমনকি রাজাকেও তাদের হুকুম মেনে চলতে বাধ্য করতেন। রাজাকে ও জনগণকে বশে রাখার জন্য ধর্মযাজকরা ঐশী বাণীর নামে নিজেদের মনগড়া মতবাদ রাজা ও জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতেন। এতে রাজারা ধর্মযাজকদের অনেক আদেশই মানতেন না; বরং বিদ্রোহ করে বসতেন। ধর্মযাজকরা রাষ্ট্র পরিচালনায় ঐশী ক্ষমতা দাবি করায় এবং রাজারা, বিশেষত রোম সম্রাট কনস্টান্টিনের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পরে ধর্মীয় ক্ষমতা পরিচালনার দাবি করায় যে বিরোধ সৃষ্টি হয় শেষ পর্যন্ত ৩১২ খ্রিষ্টাব্দে মিলান ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার একটি আপসরফা হয়। এ ঘোষণায় স্থির হয় - ‘সিজারের পাওনা সিজারকে দাও, গডের পাওনা গডকে’। এই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শুরুর কথা।

১৫ শতাব্দীতে খ্রিস্টান ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের অমিল প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এ সময়ে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ ঘটলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সাথে যাজকদের মনগড়া কথার কোনো মিল না পাওয়ায় বেঁধে যায় ধর্ম আর বিজ্ঞানে তথা গির্জা আর রাষ্ট্রের বিরোধ। রাজা ও গির্জায় যুদ্ধ করেই গির্জাকে হারিয়ে দিয়ে রাজার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনই সন্ধি হয় যে, পোপ রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করবেন না এবং রাজাও ধর্মকর্মে নাক গলাবেন না। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ মতবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ সময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল প্রবক্তা ছিলেন জ্যাকব হলিয়ক (১৮১৭-১৯০৪)। তিনি প্রথমত ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, পাদ্রিদের কর্মকাণ্ডে চার্চের প্রতি বিমুখ হয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৪১ সালে সম্পূর্ণভাবে চার্চ ত্যাগ করেন। বাকি জীবন তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যান। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে - চার্চের যাজকদের অত্যাচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মের বিরোধিতা থেকে যে ভ্রান্ত মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জন্ম হয়েছে, তা কখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে জন্য শান্তি বয়ে আনতে পারে না। খ্রিষ্টান জগতের এই বিতর্কিত মতবাদ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা আছে এমন কিছু বুদ্ধিজীবীকে টাকার বিনিময়ে কাজে লাগাচ্ছে।

অথচ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্পিরিট ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না, বরং স্পিরিট ছিল একটি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন। পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই সদ্য জন্ম নেয়া গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হলেও আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কোনো উচ্চবাচ্য না করে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি যুক্ত করায় খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এমনকি দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে সপ্তাকাশে পাঠিয়ে দিলেও তাদের চেতনায় প্রতিবাদের কোনো চিহ্ন লক্ষ করা যায় না; বরং সব কিছুতেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে টেনে এনে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রগতিশীল নামের কিছু রাজনৈতিক নেতা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’ বলে সাধারণ মানুষকে বোকা বানাতে চায়। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক স্বার্থ এবং বিদেশী প্রভুদের খুশি করার জন্য তাদের এই প্রচেষ্টা।

আমাদের পাশের রাষ্ট্র ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার হলেও শাসনতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো বিধান নেই। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ ধারায় সব মানুষের ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও তাদের মূল চিন্তা ভারত হবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র ও হিন্দু ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য রাষ্ট্রীয় টাকা ব্যয় করা হয়। ভারতীয় মুসলমানদের ওপর কী নির্মম অত্যাচার করা হয় তা কারো অজানা নয়। সেখানে শত শত মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, আইন করে গরু জবাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানসহ সবার নামের আগে ‘শ্রী’ বসানো এবং অভিবাদন হিসেবে হাত জোড় করে ‘নমস্তে’ বলা সরকারিভাবে চালু করা হয়েছে। বিজেপি প্রধান অমিত শাহ এবং অনেক বিজেপি নেতা বাঙালি মুসলমানদের সেই দেশ থেকে বের করে দেয়ার কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। মুসলমানদের ওপর এত নিষ্ঠুর ও নির্মম আচরণ করলেও এর প্রতিবাদস্বরূপ আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মুখে কোনো আওয়াজ শোনা যায় না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্রিটেনের রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে প্রোটেস্ট্যান্ট অ্যাংলিক্যান খ্রিষ্টধর্ম। রাজা এ ধর্মেরও প্রধান এবং রাষ্ট্রেরও প্রধান। সে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় প্রার্থনা দিয়ে পাঠ শুরু হয় এবং আদালতে ধর্মীয় মতে শপথ পাঠ করানো হয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকেও ধর্মীয় গ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করতে হয়। ব্রিটেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, গ্রিস, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ডোমিনিক্যান ও অস্ট্রেলিয়ার পতাকাতে যে ক্রসচিহ্ন আছে তা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতীক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিষ্টধর্মই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনগতভাবে স্বীকৃত ধর্ম এবং এই ধর্মের নীতিই সেখানে সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের গায়ে স্পষ্টতই ‘ইনগড উইথ ট্রাস্ট’ লিখে তাদের জীবনে ধর্মীয় গুরুত্ব ও মর্যাদা সংরক্ষণ করে স্বধর্মের প্রাধান্য বজায় রেখেছে। ওই সব রাষ্ট্র নিজেদের সেক্যুলার রাষ্ট্র বললেও তারা কথায় কথায় সব কিছুতে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলে না; বরং তারা জানে তাদের রাষ্ট্রে সব ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। এর পরও ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলাম ধর্মের লোকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন কম হয় না।

চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চলছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাসের নজিরবিহীন অত্যাচার করে তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। এসব ব্যাপারে আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কোনো কথা বলতে শোনা যায় না।

আমাদের দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকেই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ না হলে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি আইনশৃঙ্খলাগত সমস্যা সঙ্কটমুক্ত হওয়া যাবে না। তথাকথিত এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমার প্রশ্ন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল এবং বর্তমান সংবিধানেও তা আবার সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু এই দুই সময়ে কি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভ‚লুণ্ঠিত হয়নি? এই দুই সময়ে কি মানুষের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়নি? বর্তমানে সংখ্যালঘুরা কি বেশি মাত্রায় নির্যাতিত হচ্ছে না? প্রতি দিনই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের খবর আমরা পেয়ে থাকি। তাই আমি মনে করি, রাষ্ট্রকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধর্ম বাধা নয়; আমাদের মস্তিষ্কজনিত সমস্যা। বরং ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রে চিরস্থায়ী শান্তি আনা সম্ভব।

রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষকে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হতে হচ্ছে। নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা এর কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না, আবার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করছেন না। মনে হয় এতে তারা উল্লসিত হন। ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তরালে তাদের এই উল্লসিত মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সমাজে চিরস্থায়ী অশান্তি বিরাজ করবে। কাজেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ধর্মকে দায়ী না করে বিবেকের চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ধর্মই আপনাকে শান্তির সঠিক ঠিকানা দিতে পারে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমেই একটি বর্বর জাতিকে পুরোপুরি সভ্য করে তুলেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও তাই হয়েছে। মানুষ যখন ধর্মীয় অনুশাসনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব মতবাদে চলতে শুরু করল এবং নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বলে দাবি করল তখন থেকেই মূলত রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি পরিহার করতে হবে।

harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement