২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত

-

ঢাকায় সাংবাদিকদের এক মহাসমাবেশে একজন খ্যাতিমান সাংবাদিকের বক্তৃতার একটি লাইন প্রায়ই মনে পড়ে। সেটি হচ্ছে ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলাম, জানি না বাড়ি ফিরতে পারব কি না’। আমিও এই লেখার মাধ্যমে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আজ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলাম এটা জেনেও যে, এর জন্য হয়তো অনেক সাংবাদিকের বিরাগভাজন হতে হবে।

আমাদের দেশে জাতীয়, স্থানীয় অনেকগুলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। যখন যে সরকার আসে তার সুনাম সুখ্যাতির পাশাপাশি গঠনমূলক সমালোচনা ছাড়াও দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে পত্রিকাগুলো। মজলুম জনগণের অধিকার আদায় এবং দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদান রাখছে। গণতন্ত্রের পক্ষে মজবুত হাতিয়ার হলো সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে অনেক অনলাইন পত্রিকা ও টিভির আত্মপ্রকাশ হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তাৎক্ষণিক খবর জানাজানি তো হচ্ছেই, সরাসরি সম্প্রচারও হচ্ছে হরদম। বাধ্য হয়ে প্রিন্ট পত্রিকাগুলোর মালিকেরা অনলাইন সংস্করণ বা ই-পেপার প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছেন সময়ের প্রয়োজনে।

সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সম্মানের পেশা। তবে যেকোনো সংবাদমাধ্যমে পেশাদার সৎ নির্ভীক সাংবাদিক না থাকলে সেটি বেশি দিন সচল রাখা বা মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। হামলা মামলা হতে পারে যেকোনো সময়। হচ্ছেও তাই। সৎ সাংবাদিকদের ওপরই মূলত হামলা মামলা হয় বেশি। বর্তমান সময়ে সৎ সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে এই কঠিন মুহূর্তেও নবীন প্রবীণ অনেক সৎ সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে শক্ত হাতে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিনিময়ে পাচ্ছেন মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা।

কথায় বলে, সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। সংবাদপত্র জাতির দর্পণ। সাংবাদিকরাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের, রাষ্ট্রের উপরতলা থেকে নিচতলার জনপ্রতিনিধি, কর্মকর্তা কর্মচারীদের সর্বোপরি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সুনাম সফলতা ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতা থেকে শোধরানোর উপায় বাতলে দেন বা তুলে ধরেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু জাতির বিবেক যারা তাদেরও তো আত্ম-সমালোচনার দরকার। সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে তাহলে ভূত তাড়াবেন কী দিয়ে? যাদের কাছে জাতি তথা বিশ্ববাসী অনেক কিছু পেতে আশা করে তাদের মধ্যে যদি বিষফোঁড়া বা ক্ষত সৃষ্টি হয় সেই বিষফোঁড়া বা ক্ষতের উপশম করবে কে? এদের বেশির ভাগ যদি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার পরিবর্তে নিজের আখের গোছাতে স্বার্থ হাসিলের ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাহলে তার পরিণতি কী হবে? ধানে কিছু চিটা থাকা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু চিটা যদি হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত তবে তো কথা থেকেই যায়!

দেখা যায়, বেশির ভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে অফিস খোলেন। অফিস প্রধান, ব্যুরো প্রধান, প্রতিনিধি এবং রিপোর্টার নিয়োগ করেন। দেশের অনেক জেলা, উপজেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরেও প্রতিনিধি নিয়োগ দেন। এসব প্রতিনিধির কাজ হলো নিজ এলাকার কোথায় কি ঘটছে সে খবর সংগ্রহ করে নিজ নিজ পত্রপত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলে পাঠানো।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তাদের প্রতিনিধিদের নিয়োগ প্রদান করে নিয়োগপত্রের মাধ্যমে এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছ-বিচার করে। নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকে চাকরির শর্তাবলী। পাশাপাশি উল্লেখ থাকে প্রতিনিধির বেতন সুযোগ-সুবিধা কিংবা ভাতার কথাও। এর মধ্যেও দু-একটি ছাড়া প্রায় সব পত্রিকা কর্তৃপক্ষই এই ভাতার যে অঙ্ক উল্লেখ করেন তা রীতিমতো লজ্জাজনক। আবার কোনো কোনো মিডিয়া কর্তৃপক্ষ কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বেতন-ভাতার উল্লেখ না করে তা গোপন রাখেন।

একজন সংবাদকর্মীকে দু-তিন বছর জুতোর তলা ক্ষয় করানোর পর নিয়োগপত্র দেন মুষ্ঠিমেয় কিছু পত্রিকা বা মিডিয়া কর্তৃপক্ষ। দু-চারটি পত্রপত্রিকা ছাড়া নিয়োগপত্রে উল্লেখিত বেতন বা ভাতার সামান্য টাকা এবং ফোন ও ই-মেইলের বিল এবং অফিস খরচ পরিশোধ করেন না। অনেক পত্রিকা বা মিডিয়া কর্তৃপক্ষ নিয়োগপত্রও দেন না। শুধু একটা কার্ড বা পরিচয়পত্র দেন এবং নিয়োগপত্রের প্রলোভন দেখিয়ে বছরের পর বছর কলুর বলদের মতো খাটান। বছরে দু-একবার অফিসে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নীতিবাক্য শোনান আর বেশি বেশি বিজ্ঞাপন সংগ্রহের নির্দেশ দেন। নিয়োগপত্র, বেতন বা ভাতার কথা বললে কৌশলে এর জবাব এড়িয়ে অনেকেই বলে থাকেন বিজ্ঞাপন দেন।

মাগনা খাটানোতে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের শতভাগ লাভ। তবে যাদেরকে মাগনা খাটানো হয় তারা মাগনা খেটে আয় রুজি কিভাবে করেন, সংসার কিভাবে চালান সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেক সময় স্থানীয় প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয়। গাড়ি ভাড়া পকেট থেকে দিতে হয় কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে তেল ভরতে হয়। মোবাইলের বিল পরিশোধ করতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মূল্যবান সময় ও অর্থ নষ্ট করে সংবাদ সংগ্রহ করে নিজের ক্যামেরায় ছবি তুলে, কম্পিউটারে সংবাদ লিখে ছবি ঠিকঠাক করে ক্যাপশন লিখে ই-মেইলের বিল নিজের পকেট থেকে পরিশোধ করে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে বার্তা সম্পাদককে ফোন করে অতিশয় বিনয়ী কণ্ঠে সংবাদটি পরের দিন ছাপানোর জন্য বার বার তৈলাক্ত অনুরোধ করতে হয়। অনেকে বলে থাকেন, মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাক্সিলোড বা বিকাশে কিছুমিছু না পাঠালে অনেক পত্রিকার মাননীয় বার্তা সম্পাদক নাকি ফোন ধরারও সময় পান না কিংবা এত কষ্ট করে পাঠানো সংবাদটিও ডাস্টবিনে ফেলে দিতে কসুর করেন না।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে অধিকাংশ মিডিয়া কর্তৃপক্ষ জেলা উপজেলা প্রতিনিধিদের বিনাবেতনে খাটিয়ে তাদের লুটেরা বানাচ্ছেন। তাদের ভালোভাবেই জানা যে, বিনাবেতনে ইচ্ছেমতো খাটাতে হলে অযোগ্য অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ বেকার অদক্ষ লোকদেরই দরকার। তাই প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়ার সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচার করেন না অধিকাংশ তথাকথিত সম্পাদক বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। ফলে নানা ধরনের পরিবহন কর্মী, রাইস মিলের ড্রাইভার, হেলপার, রাজ কাঠ রঙ মিস্ত্রি, ধোপা, নাপিত, মুচি, দালাল, টাউট, চোরাকারবারি, আদম ব্যাপারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতরাও সময় সুযোগমতো সাংবাদিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে। প্রয়াত এক সাবেক মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সব পেশায় লোক নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা হলেও আমাদের দেশে একটি পেশায় শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার পড়ে না। সেই মহান পেশাটি হচ্ছে সাংবাদিকতা!

বেশ কয়েক বছর আগে এক সাংবাদিকের বেতনভাতার খবর জানতে চাইলে উত্তরে বলেন, ‘ভাইছাব এ পেশায় মাল কামাতে হলে অবৈধ পন্থা ছাড়া উপায় নেই। বেতন টেতন নেই, তবে সিস্টেম জানা থাকলে মাসে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা কামানো মামুলি ব্যাপার। কোনো কোনো সময় এক দিনেও বড় দান মারা যায়।’

দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু অদক্ষ অযোগ্য অশিক্ষিত লোকেরা সাংবাদিকতার মহান পেশাকে কলুষিত করে জাতির ভয়াবহ ক্ষতি করে যাচ্ছে। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই।

সংবাদপত্র হচ্ছে জাতির আয়না। দেশ ও জাতির উন্নয়ন অগ্রগতি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে তা সংশোধনের পথ বাতলে দেয়া সংবাদপত্রের কাজ। অশিক্ষিত, মূর্খ, দুর্নীতিবাজ, বাটপারদের দিয়ে মহান এ পেশাকে কলুষিত করা হলে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ কোন দিকে যাবে সে বিচারের ভার বিজ্ঞ পাঠকমহলের ওপরই ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

এতসব ভেজালের ভিড়ে এখনো কিছু নির্ভীক কলমসৈনিক সৎ সাংবাদিক আছেন যারা সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেও দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজের শ্রম ও মেধা কাজে লাগাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে, প্রকাশ করে যাচ্ছেন পত্রপত্রিকা, সর্বোপরি দেশ ও সমাজের উন্নয়নে রেখে যাচ্ছেন অসামান্য অবদান। তাদের সততার নজির দেখলে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।

Email: nazmulsylhet@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
মুজিবনগরে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৩ বাগেরহাটের রামপালে ট্রাকের চাপায় নিহত ৩ ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব আফ্রিকায় প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা, কমপক্ষে ১৫৫ জনের প্রাণহানি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন উগ্র ইসরাইলি মন্ত্রী শেরে বাংলার সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন হাত কাটা বন্দীর নেতানিয়াহুর সমালোচনা ইসরাইলের আলটিমেটাম, যা বলল হামাস রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থনের বিরুদ্ধে ব্লিংকেনের হুঁশিয়ারি ইতিহাস গড়া জয় পেল পাঞ্জাব

সকল